এ যেন ‘দাদাগিরি’র বিকেন্দ্রীকরণ।
এলাকার ‘দাদা’দের কাছে মাসিক একটি অঙ্কের টাকা পৌঁছে যেত। ফলে এলাকায় সব কিছুই ছিল তাঁদের নজরদারির আওতায়। আবার সেই ‘দাদা’দের নিয়ন্ত্রণের রাশ ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দিষ্ট অংশের হাতে। ফলে এলাকায় ছিল ‘শান্তি’।
সময়টা ছিল বাম আমলের, তৃণমূলের জমানায় সেই রাশ আলগা হল। অধিক ‘সন্ন্যাসী’র উদয় হওয়ায় সেই নিয়ন্ত্রণটাই উঠে গেল।
যেখানে সহজে, কম বিনিয়োগে বিশাল পরিমাণ কাঁচা টাকার লাভ রয়েছে, সেখানেই গোলমাল বাধল। তার জেরে কখনও সিন্ডিকেট নিয়ে চুলোচুলি, কখনও এলাকার দখলদারি নিয়ে খুন। তারই একটি ছাপ পড়েছে ভেড়ি এলাকাতেও।
সল্টলেকের ভেড়ি এলাকায় গত সাত মাসে দু’জন ভেড়ি শ্রমিক খুন হয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাতে ভেড়ি শ্রমিক শিবানী মণ্ডলের খুনের ঘটনায় ছয়নাবি এলাকার বাসিন্দা ভূপাল মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই ঘটনাই ফের দেখিয়েছে, বিধাননগরের ভেড়ি এলাকায় মাছ ব্যবসার ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
এক সময়ে রাজারহাট-নিউ টাউন মেগাসিটি প্রকল্পকে ঘিরে জন্ম নিয়েছিল সিন্ডিকেট। স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থানের স্বার্থে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘কো-অপারেটিভ’। অসংখ্য যুবক ভিড় করে সেই সমবায়ে। শুরু হয় ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহ। কাঁচা টাকা উড়তে থাকে। ‘দাদা’দের নিয়ন্ত্রণ থাকায় বাম আমলে কিন্তু সে অর্থের গোলমাল দেখা যায়নি।
কিন্তু শাসন ক্ষমতা বদলালেই রাতারাতি পরিস্থিতি বদলায়। পুরনো ‘দাদা’রা এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে পড়ে এক-এক জন নেতার দলে নাম লেখায়। এ ছাড়া নতুন গজিয়ে ওঠা ‘দাদা’রাও দাপট দেখাতে শুরু করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শুরু হয় দখলদারির গোলমাল।
রীতিমতো সিন্ডিকেটের ম্যাপ অনুসারে এলাকা বিন্যস্ত হয়ে পড়ে। এলাকার দখলদারি নিয়ে সংঘর্ষ, গোলমাল বাড়তে থাকে। খুন-জখমে সরগরম হতে থাকে এলাকা। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বাগুইআটির জগৎপুর। বখরা নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুন হয় এক যুবক।
তবে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। সিন্ডিকেটের পাশাপাশি সেই সব ব্যবসাতেও একই ছবি দেখা যায়, যেখানে কম বিনিয়োগে বিশাল অঙ্কের কাঁচা টাকার রমরমা।
সেই দৌরাত্ম্যই থাবা বসিয়েছে সল্টলেকে। এখানেও বিকেন্দ্রীকরণের ছবি স্পষ্ট। প্রকাশ্যে প্রোমোটারকে হুমকি দিয়ে গ্রেফতারও হয়েছিলেন এক তৃণমূলকর্মী। সুকান্তনগর-সহ একাধিক সংযুক্ত এলাকায় বৈধ অনুমতি ছাড়াই নির্মাণের রমরমা। তাই নিয়ে মাঝেমধ্যেই গোলমাল লেগে রয়েছে। সম্প্রতি সেই সব নির্মাণকাজ স্থগিত রেখেছে বিধাননগর পুরসভা।
একই দশা ভেড়ি এলাকাতেও। পরপর খুন হয় দুই ভেড়ি শ্রমিক। পুলিশের দাবি, মাছ চুরি আটকাতে গিয়েই এই খুনের ঘটনা। মাছ চোরেরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
কিন্তু যে এলাকায় ‘দাদা’দের অনুমতি ছাড়া মাছি গলে না, সেখানে লাগাতার মাছ চুরি করে বাজারে বিক্রি করার মতো সাহস দুষ্কৃতীরা পায় কোথা থেকে?
স্থানীয় সূত্রের খবর, সাদা চোখে বলতে গেলে নতুন নতুন নেতাদের হাতে এখন এলাকার রাশ। কিন্তু নেতাদের নিজেদের দ্বন্দ্বে এলাকায় নিয়ন্ত্রণ বলে কিছুই নেই। সেখানে প্রতিবাদ করলে মৃত্যু অনিবার্য, এমনটাই বলছেন বাসিন্দারা।
বিরোধী বাম, কংগ্রেস কিংবা বিজেপি-র অভিযোগ, সরাসরি শাসক দলের নেতারা এই সব ক্ষেত্রে মদত দিচ্ছেন। তৃণমূল নেতাদের অবশ্য দাবি, কর্মসংস্থানের স্বার্থে এলাকার যুবকেরা ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ থেকে প্রোমোটিং-সহ নানা ব্যবসা করে। মাছ চাষ কিংবা ভেড়ি ব্যবসাও তেমনই একটি। শাসক দলের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে এই সব যুবকেরা। এটা নতুন নয়। তার সঙ্গে দলকে জড়িয়ে দেওয়া অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy