হলই বা নারীর উপাসনা! এত দিন সর্বজনীন কিংবা আবাসনের পুজোর রাশ হাতে রাখতেন পুরুষেরাই। কিন্তু পুজোর ময়দান বলছে, উৎসব কাপের এই রীতিটাও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। শহরের সর্বজনীন কিংবা আবাসনের পুজোয় ক্রমশ উঠে আসছেন মহিলারা। সহকারী বা নেপথ্যচারিণী হিসেবে নয়, ‘পুজোকর্তা’ হিসেবে!
৫১ বছরের পুরনো পুজো উত্তর কলকাতার কালী দত্ত স্ট্রিট সর্বজনীন। বছর ষোলো আগে পুরুষদের বদলে মহিলাদের হাতে আসে ক্ষমতা। ওই পুজোর বর্তমান সভাপতি মিলি দত্তের কথায়, ‘‘উত্তর কলকাতায় এটিই প্রথম মহিলা পরিচালিত পুজো।’’ কমিটি বদল হলেও পুজোর চেহারা বদলাননি মিলিদেবীরা। চিরকালীন সাবেক রূপেই পুজো চলছে। কুমারী পুজোর আয়োজনও রয়েছে। উৎসবের দিনগুলিতেও পালা করে দায়িত্ব পালন করেন মহিলা সদস্যেরা।
বছর আষ্টেক আগে শুরু হওয়া বেহালার রায়বাহাদুর রোডের নেতাজি স্পোর্টিং অবশ্য সাবেক পুজোর রীতি বদলে ফেলেছে। গোটা পুজো সামলাতে কোমর বেঁধেছেন এলাকার জনা ষাটেকের প্রমীলা-বাহিনী। ফি বছরই নতুন নতুন থিম গড়ে তুলছেন তাঁরা। এ বছর যেমন শিল্পী প্রদীপ দাস সেখানে তুলে ধরছেন ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ থিম। প্রতিমা গড়ছেন প্রদীপের ‘গুরু’ তরুণ দে। পুজো কমিটির প্রচার-সচিব শিল্পী দেব বলছেন, ‘‘গত আট বছর ধরে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই পুজো করছি আমরা।’’
‘বারো ঘর এক উঠোন’ সামলানোটাই যথেষ্ট কঠিন। সেখানে বত্রিশ ঘরের এক উঠোনে পুজো করছেন লেক গার্ডেন্সের বৈজয়ন্ত আবাসনের মহিলারা। পুজো কমিটির সদস্যদের কেউ গৃহবধূ, কেউ বা স্কুলশিক্ষিকা। ঘর, অফিস সব কিছু সামলেও পুজোর দায়িত্ব নিতে পিছপা নন তাঁরা। পুজো কমিটির এক সদস্যা বলছেন, ‘‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না?’’ পুজোর বাজেট, চাঁদা তোলা, কেটারারের সঙ্গে কথা বলা— সবই করছেন মহিলারা।
আশপাশে সবাই জাঁকজমকের থিম পুজো করছে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে পাড়ার মণ্ডপে বু়ড়ো আর শিশুদের চেনা হইচই, আনন্দ। এই বিষয়টিই নাড়া দিয়েছিল উত্তর কলকাতার সাবেক এলাকা বিডন রো-র মহিলাদের। তাই প্রায় এক যুগ আগে তৈরি হয়েছিল ‘সুচেতনা’। শুরু হয়েছিল মহিলাদের পুজো। এলাকার বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যেরা বলছেন, নেহাত কাগুজে কমিটি হয়ে নয়, এই সংগঠনের মহিলারা বাস্তবেই কোমর বেঁধে পুজো করতে নামেন। কুমোরটুলি থেকে ট্রলিতে চাপিয়ে প্রতিমা আনা হোক কিংবা বিসর্জনের শোভাযাত্রা— প্রতিমাকে ঘিরে থাকেন নারীরাই।
বছর বারো আগে পুজো শুরু হয়েছিল সাবেক ঘরানায়। ক্রমে পরিবর্তন হয়ে থিম পুজোতেও হাত পাকিয়েছিল ‘সুচেতনা’। ভাঁড়ার তেমন জোরালো না হওয়ায় এ বার অবশ্য ফের সাবেক পুজোতেই ফিরে গিয়েছেন বিডন রো-র প্রমীলা বাহিনী। পুজো থিম না সাবেক, তা নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামাতে রাজি নন কমিটির সম্পাদক সান্ত্বনা নাগ কিংবা বেবি বসাকের মতো সক্রিয় সদস্যেরা। তাঁরা বলছেন, উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়াটাই আসল। কারণ, মহিলাদের পুজো হলেও উৎসবের সময়ে মণ্ডপে নেমে আসে গোটা পাড়া। কোনও বৃদ্ধা অভিভাবক টুল পেতে বসে পুজোর গোছগাছ তদারকি করেন আবার নাড়ু তৈরির নারকেল কুরোতে পাশাপাশি বসে পড়েন গৃহবধূরা। বেবির কথায়, ‘‘পুজোর ক’দিন পাড়াটা এক কথায় যৌথ পরিবার হয়ে ওঠে।’’
উৎসবে যাতে রাজনীতির রং না লাগে, তা-ও এ বার চ্যালেঞ্জ পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের নারীবাহিনীর কাছে। এক সময়ে শহরে সাড়া জাগানো এই পুজো রাজনৈতিক টানাপড়েনে জৌলুস হারিয়ে ফেলেছিল। পুজোকে ঘিরে রাজনৈতিক লড়াইও শুরু হয়েছিল। পাড়ার পুজোর জৌলুস ফেরাতে তাই পুরুষদের সরিয়ে পুজোর দায়িত্ব নিয়েছেন জুঁই দত্ত, মধুমিতা দে-র মতো পাড়ার আটপৌরে গিন্নিরাই। পুজো কমিটির সম্পাদিকা জুঁই দত্ত বলছেন, ‘‘পাড়ার পুজোর জৌলুস ফেরানো যেমন লক্ষ্য, তেমনই রাজনীতির আবর্ত থেকে বার করে আনাটাও চ্যালেঞ্জ।’’ দর্পনারায়ণের থিমেও এ বার দেবী ‘আটপৌরে নারী’। শিল্পী প্রশান্ত দাসের তৈরি গোয়ালঘরের আদলে মণ্ডপে দুর্গা থাকছেন গোয়ালিনী রূপে।
দুর্গা যেমন শিব ছাড়া সম্পূর্ণ হন না, তেমনই এই মহিলাদের পুজোতেও পুরুষেরা কিন্তু রয়েছেন। তবে অলক্ষ্যে। কোথাও তাঁরা প্রশাসনের কর্তা হিসেবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কোথাও বা স্বামী, সন্তান কিংবা আত্মীয় হিসেবে। মিলিদেবী যেমন বলছেন, মহিলারা পুজো করছেন দেখে প্রশাসন সব সময়ে পাশে থাকে। পুজোর দিনে থানার অফিসারেরা বারবার টহল দিয়ে যান। বৈজয়ন্ত আবাসনের মহিলা সদস্যদের সব সময়ে উপদেশ দিচ্ছেন পুরুষ আবাসিকেরা। এমনকী, দর্পনারায়ণের ‘ক্ষমতাচ্যুত’ পুরুষদের কাছ থেকেও প্রয়োজন মতো পরামর্শ নিচ্ছেন জুঁইরা।
উৎসব কাপে এ বার লড়াই কিন্তু পুরুষ বনাম নারীরও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy