টিকিট না পেয়ে হতাশ ভিন্দেশি সমর্থক। শনিবার, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
শনি-সন্ধ্যায় সল্টলেকের গ্যালারিতে ব্রিটেনের ডেপুটি হাই কমিশনার ব্রুস বাকনেলের শরীরি ভাষা যেন দৃশ্যতই প্রতীকি।
গোড়ায় গোড়ায় দু’গোল খেয়ে তাঁর দেশের খুদে সিংহেরা ধপাস হতে প্রায় কুঁকড়ে মাটিতে মিশেই যাচ্ছিলেন তিনি। ম্যাচের রং বদলানোর সঙ্গে সেই নুয়ে পড়া অবয়বও পাল্টালো ধাপে ধাপে। ইংল্যান্ডের পাঁচ-পাঁচটি গোলের প্রত্যেকটিতে ডেপুটি হাই কমিশনারের লম্ফঝম্পের মাত্রা চড়ল একটু একটু করে। পিছিয়ে থাকা ইংল্যান্ড স্পেনকে টপকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে ভিআইপি গ্যালারিতে ব্রুস প্রায় হাইজাম্প দিয়ে উঠলেন। ম্যাচ শেষে চমৎকার ফুটবল ও কলকাতার মাঠের অসামান্য পরিবেশের প্রশংসায় থামতেই চাইছিলেন না তিনি।
একই সময়ে সদর স্ট্রিটের চিলতে কাফের ছবিটাও কম প্রতীকি নয়। পাঁচ-সাত বছর আগের হুল্লোড়ে পরিবেশের ধারেকাছেও নেই কিছু।
২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকায় স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ের বছরে তো বটেই, ২০১২-র ইউরো সকারের সময়েও এই আড্ডাঠেক জেগে থাকত মাঝরাত্তির পার করে। এ তল্লাটে মাদার হাউসে কাজ করতে বা বেড়াতে স্প্যানিশভাষী অতিথিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসেন দেখেই নিজে ভাষাটা রপ্ত করেছিলেন রাজেন্দ্রকুমার পাল।
তার পরেই কাফেটা খোলেন। বিশ্বকাপ বা ইউরো কাপের দিনগুলোয় কাফের চেয়ারটেবিল সরিয়ে দিতেন তিনি। দেশের চিরকেলে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে জড়ো হত স্পেনের ছেলেবুড়োর দল। গভীর রাতে পিৎজা-পাস্তা যোগে নরক গুলজার, ফুটবল ও স্পেনের টানেই।
খাস কলকাতার মাঠে ভিয়া-তরেসদের দেশের বিশ্বকাপ ফাইনালে সেই কাফে শুরুতে সামান্য তেতেও এক্কেবারে নেতিয়ে গেল। খুদে ফুটবলবীর আবেল রুইজ, সার্জিও গোমেজদের হয়ে গলা ফাটানোর সেই স্প্যানিশ বেরাদরি নিমেষে উধাও। শুরুতে ছবিটা খানিক অন্য রকম ছিল। আর্জেন্তিনার বন্ধু মার্টিনকে সঙ্গে নিয়ে তখন কফি হাতে বসেছেন মাদ্রিদের গুইয়েরমো দিয়েজ। কলকাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে স্পেনের প্রতিপক্ষের কথা উঠতেই স্প্যানিশ ভাষায় কিছু সংলাপের সঙ্গে হাসির ফুলঝুরি ছুটল। কাফের মালিক রাজ হাসতে হাসতেই বোঝালেন, ‘‘বুঝলেন না, এ হল মেঠো গালাগালি। ‘অমুকনন্দন’ বলে সম্বোধন করছে।’’ খানিক অপ্রস্তুত স্প্যানিশ যুবা গুইয়েরমো আবার বোঝালেন, ‘‘আ-হা, মজা করে বলেছি, কিন্ত খেলার উত্তেজনায়। সত্যি সত্যি মন থেকে কিছু বলছি না মোটেও!’’
খেলা শেষে মাঠের সৌজন্যের আবহেও কম পড়েনি একটুও। ব্রিটেনের হাই কমিশনার ডমিনিক অ্যাসকুইথ ও স্পেনের রাষ্ট্রদূত হোসে রামোন বারানানো দু’জনেই দিল্লি থেকে খেলা দেখতে এসেছেন। ম্যাচ শেষে হাত মিলিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
সদর স্ট্রিটের স্প্যানিশ অতিথিদের তখন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। ফুটবলপাগলদের প্রিয় কাফেতে স্পেনের সমর্থক, জনৈক ইতালীয় মহিলা মিলানের পাউলা প্লেবানি কাষ্ঠহাসি হেসে গাত্রোত্থান করলেন। আর ব্রাজিলের ফোর্তা লেজা থেকে ভারত-ভ্রমণে আসা কবি ইতালো রোভেরে ব্যস্ত হয়ে বোঝাতে শুরু করলেন, ‘‘সেই ২০ বছর আগে ব্রাজিল জিদানের ফ্রান্সের কাছে হারের পর থেকেই বিশ্বকাপের স্কোরগুলো ঠিক বিশ্বাস করি না। ফিফার বহুত গোলমাল। আমাদের দেশের হ্যাভেলাঞ্জও সুবিধের ছিলেন না।’’
এ সব জল্পনা-কল্পনায় অবশ্য কান দিতে বয়েই গিয়েছে বালিগঞ্জের বাসিন্দা, ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রাক্তন অধিকর্তা সুজাতা সেনের। ফাইনালের টিকিট পেয়েও বর্তমানে যে স্কুল তথা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে তিনি যুক্ত, তার ছেলেমেয়েদের সব বিলিয়ে দিয়েছেন সুজাতা। তার বদলে বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে খেলা দেখবেন বলে নানা কিসিমের চিজ-ক্র্যাকার সুরার বন্দোবস্ত রেখেছিলেন। ম্যাচ শেষে তাঁর গলার উচ্ছ্বাসে মালুম হল, সন্ধেটা বৃথা যায়নি।
এই সন্ধেটাই অবিশ্বাস্য ঠেকছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক সৌরভ মজুমদার বা দীর্ঘদিন স্পেনে কাটানো গড়িয়াবাসী সোমা সরকারের কাছে। এ ভাবে জোড়া গোলে এগিয়েও ম্যাচ হাতছাড়া হবে ভাবেননি তাঁরা। কাতালোনিয়া ও মাদ্রিদের টক্করে দীর্ণ স্পেনের সময়টা যে ভাল যাচ্ছে না, এ দিন তা-ও স্পষ্ট মালুম হল।
শেষ কথাটা অবশ্য রসিক কলকাতাই বলে গেল! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাঠে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে উঠেছেন দেখেই শহরের চেনা রসিকতা, লন্ডনে কি ইংল্যান্ডকে হারানো যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy