Advertisement
১১ মে ২০২৪

চুরি হয়ে গেছে রাজপথে

ড্রয়িংরুমের শো-কেস থেকে রবিঠাকুরের রাস্তায় নেমে আসার দাবিতেই সরব হয়েছিলেন তাঁরা।

রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের জন্য বন্ধ রাস্তার এক দিক। মঞ্চ তৈরি করতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে ডিভাইডারের একাংশও। মঙ্গলবার, ক্যাথিড্রাল রোডে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের জন্য বন্ধ রাস্তার এক দিক। মঞ্চ তৈরি করতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে ডিভাইডারের একাংশও। মঙ্গলবার, ক্যাথিড্রাল রোডে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১২:২৭
Share: Save:

কয়েক দিন আগেই শহরের এক বই বিপণিতে রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত শঙ্খ ঘোষ, সৌরীন ভট্টাচার্য, অমিয় দেবের মতো বক্তাদের মূল দাবি ছিল একটাই, রবীন্দ্রনাথ সাধারণের মধ্যে নেমে আসুন। তাঁর সঙ্গে সাধারণ পাঠকের সব দূরত্ব ঘুচে যাক। ড্রয়িংরুমের শো-কেস থেকে রবিঠাকুরের রাস্তায় নেমে আসার দাবিতেই সরব হয়েছিলেন তাঁরা।

রবীন্দ্রনাথ রাস্তায় নামেন! এমনকি, কোনও কোনও জায়গায় রাস্তা জুড়েও থাকেন। আক্ষরিক অর্থেই। প্রতি বছরের রবীন্দ্রজয়ন্তী এলে তেমনটাই তো দেখা যায়! পাড়ায় পাড়ায় তো বটেই, এমনকি, খোদ সরকারি অনুষ্ঠানও তো রাস্তার এক দিক বন্ধ করেই হয়। তাতে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মানসের কতটা দোসর হয়েছেন, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। কিন্তু রাস্তা বন্ধের ফলে সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তি বাড়ে, তা নিয়ে নিঃসংশয় সকলেই।

তবে রাস্তা বন্ধ করে ‘রবিপুজো’র বিষয়টি এ বার আলাদা মাত্রা পেয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায়ের প্রেক্ষিতে। গত সপ্তাহেই হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিয়ে বলেছে, রাজ্য জুড়ে যে সব বড় ও প্রধান সড়ক রয়েছে, সেগুলি পুরোপুরি আটকে কোনও জনসভা বা মিছিল করা যাবে না।

হাইকোর্টের ওই রায়ের জেরে পূর্ব নির্ধারিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মসূচি কী ভাবে পালিত হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। ২১ জুলাইয়ের সমাবেশই হোক বা কোনও ধর্মীয় শোভাযাত্রা, এ শহরে রাস্তা আটকে উদ্‌যাপনের তালিকাটি ছোট নয়। বাদ পড়েনি রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও। কারণ, রবীন্দ্র সদনের বাইরে ক্যাথিড্রাল রোডের এক দিক বন্ধ করে ওই অনুষ্ঠান তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হয়ে আসছে। এটি মিছিল বা সেই অর্থে কোনও জনসভা না হলেও মঞ্চ বাঁধা থেকে শুরু করে সামগ্রিক অনুষ্ঠানপর্বের জন্য দু’তিন দিন বন্ধ থাকে রাস্তার এক দিক। ফলে রবিপ্রণামে কার্পণ্য না রেখেও অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, রবিপ্রণামের অনুষ্ঠান কি কোনও ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজন করা যায় না! বিশেষ করে, এই সরকারই তো নন্দনের স্বল্প পরিসর থেকে চলচ্চিত্র উৎসবকে বার করে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়েছে। তাতে উৎসবের জনপ্রিয়তা কমা তো দূর, বরং বেড়েছে।

অতীতে বরাবর রবীন্দ্রজয়ন্তী রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হত। রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে ওই কবিপ্রণাম অনুষ্ঠানে এখনকার মতোই সকলের অবাধ প্রবেশ ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলত সেই অনুষ্ঠান। সাধারণ মানুষ তাতে যোগ দিতেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণের পরিসর কমে যাওয়ায় সেখানে অত দর্শক-শ্রোতার জন্য জায়গা হত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম রবীন্দ্র সদন চত্বর থেকে বার করে ক্যাথিড্রাল রোডে নিয়ে আসেন কবিপ্রণাম অনুষ্ঠান। সময় বদলে যায়। সকাল হয়ে যায় বিকেল। এই অনুষ্ঠানেরও তুমুল জনপ্রিয়তা। কিন্তু রাস্তার এক দিক বন্ধ রেখে মানুষের অসুবিধা তৈরি করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত, হাইকোর্টের রায় সেই ভাবনাই উস্কে দিয়েছে। প্রতি বছরই রাস্তা আটকানোর পাশাপাশি অনুষ্ঠান মঞ্চ তৈরি করতে গিয়ে কেটে ছোট করে দেওয়া হয় পথের ডিভাইডার! পরে আবার তৈরি করে দেওয়া হয় তা।

অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন, ‘‘আসলে এটাকে রবি-হুল্লোড় বলা যায়। আর রবি-হুল্লোড় শুধু ব্যক্তিমানসকে প্রভাবিত করে না, প্রতিষ্ঠানকেও করে। তাই হয়তো রাস্তা বন্ধ করে অনুষ্ঠান হয়!’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আসলে রবীন্দ্রনাথ তো সকলের। তাই কে, কী ভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করবেন, সেটা তো নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া যাবে না। তবে অনুষ্ঠান পালনে যাতে কারও অসুবিধা না হয়, সে দিকটা মাথায় রাখা উচিত।’’

রাস্তা বন্ধ করে রবিপুজোর অসুবিধার বিষয়টি আবার মানতে চাননি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য স্বপন দত্ত। স্বপনবাবুর কথায়, ‘‘এটা তো এক দিনের বিষয়। এতে তো খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে উন্মাদনা কমে গেলেই বরং চিন্তা হবে, তা হলে কি নবীন প্রজন্ম আর রবীন্দ্রনাথ ততটা পড়ছে না!’’

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার জানাচ্ছেন, ক্যাথিড্রাল রোডের এক দিক তো খুলে রাখা হয়। যান নিয়ন্ত্রণও করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কোনও প্রশ্নই নেই। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান তো আর জনসভা নয়। আর রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের ফলে কারও ভোগান্তি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE