Advertisement
০২ জুন ২০২৪

‘অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন...’

কবি শ্রীজাতের বক্তব্য, ‘‘এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। এবং কলকাতা শহরে এমন ঘটেছে বলে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

ধৃত: অসিত রাই। নিজস্ব চিত্র

ধৃত: অসিত রাই। নিজস্ব চিত্র

স্যমন্তক ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৮ ০১:২৯
Share: Save:

ভয়াবহ!

প্রকাশ্য দিবালোকে যাত্রী বোঝাই বাসে ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে এক ব্যক্তির হস্তমৈথুনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে এই একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন প্রায় সকলে— ‘ভয়াবহ’!

কিন্তু তার চেয়ে কম ভয়াবহ নয় প্রতিবাদ না করার অসুখটা। এমন হেনস্থার পরে বারবার সাহায্য চেয়ে সেটুকুও জুটল না কেন ওই ছাত্রীদের?

কবি শ্রীজাতের বক্তব্য, ‘‘এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। এবং কলকাতা শহরে এমন ঘটেছে বলে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। যে শহরে ভালবাসার প্রতিবাদ হয় মারে, সে শহরে বিকৃতির প্রতিবাদ তো নীরবতাই হওয়ার কথা!’’ শ্রীজাত জানিয়েছেন, কো-এড স্কুলে পড়ার সৌজন্যে এমন বহু ঘটনার কথা তিনি শুনেছেন। বান্ধবীরা এ ধরনের বহু অভিজ্ঞতা বন্ধুদের কাছে বলত। তবে সে সময়ে এ ধরনের ঘটনা খুব বেশি জানাজানি হত না। কারণ, তা নিয়ে আলোচনা করার রেওয়াজটা ছিল না। এখন হয়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আলোচনাই হয় শুধু? প্রতিবাদের রেওয়াজ কি তৈরি হয়নি এখনও? বাস্তব তেমনটাই দেখাচ্ছে। তবে কবির মতে, যাঁরা বাসে বসেও এই ঘটনার প্রতিবাদ করেননি, তাঁরা সমান দোষী।

তিলোত্তমা মজুমদারেরও মত একই। তাঁরও বক্তব্য, ‘‘যে সহযাত্রীরা সবটা জেনেও ওই ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াননি, তাঁরাও সমান অপরাধী। তাঁদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।’’ অভিযুক্তের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তিলোত্তমা। তবে অভিজ্ঞদের মতে, শুধু শাস্তি নয়, শহরে প্রতিবাদের স্পৃহা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে জরুরি।

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় অবশ্য বিষয়টিকে অন্য ভাবে দেখতে চাইছেন। তাঁর বক্তব্য, ইদানীং এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে হামেশাই দেখা যায়, প্রত্যক্ষদর্শীরা সাহায্যের হাত বাড়ান না। এর মূল কারণ ভয়। সকলেই ভাবেন, অভিযুক্তের সঙ্গে ক্ষমতায় তাঁরা পেরে উঠবেন না। ঠিক এই কারণেই ওই ছাত্রীরা প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সহযাত্রীরা প্রতিবাদ করেননি।

কিন্তু শহরের বুকে প্রকাশ্যে এমন ঘটনা কি ব্যতিক্রমী? নাকি এ-ও এক ধরনের সামাজিক অসুখ? ওই ছাত্রীর সোশ্যাল নেটওয়ার্কের পোস্টে এমন বহু প্রশ্ন উঠেছে। প্রশান্তবাবু বিষয়টিকে দেখতে চাইছেন অন্য দিক থেকে। তাঁর মতে, এর আগেও শহরে এমন ঘটনা ঘটেছে। ফলে বিষয়টিকে ব্যতিক্রমী ভাবার কারণ নেই। এ এক ধরনের সামাজিক রোগ তো বটেই! তবে এই ঘটনাকে অন্য বিষয়গুলির থেকে আলাদা করে দেখলে হবে না। প্রশান্তবাবুর কথায়, ‘‘সমগ্র সমাজেই এক ধরনের ভয়ঙ্কর মানসিকতার জন্ম হয়েছে। ক্ষমতা প্রদর্শন করে অপরকে ভয় দেখানোর মানসিকতা নতুন নয়। ফলে এই ঘটনাটিকে একটি ব্যতিক্রমী বিকৃতি বলা যায় না। এ-ও এক ধরনের সামাজিক ক্ষমতার প্রদর্শন। ফলে, ওই ছাত্রী ভিডিয়ো করছেন

দেখেও অভিযুক্ত সচেতন হয় না। বরং হাসে। দিকে দিকে ঘটে যাওয়া খুন, ধর্ষণ, রাজনৈতিক হিংসার সঙ্গে তাই এর তফাত নেই। পুরোটাই এক সামাজিক ক্ষমতার প্রদর্শন।’’ ফলে এর প্রতিবাদও সে ভাবেই হওয়া দরকার বলে মত তাঁর।

একই কথা বলেছেন মন-সমাজবিদ মোহিত রণদীপ। তাঁর মতে, এটি এক ধরনের প্রদর্শকাম। এর মধ্যে ক্ষমতার দম্ভই স্পষ্ট। এক জন ছাত্রী যেখানে ‘সফ্‌ট টার্গেট’। ছাত্রীর ভয়ই আসলে ওই ব্যক্তিকে আনন্দ দিচ্ছিল। দিকে দিকে এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ স্থান-কাল-পাত্রের সাধারণ জ্ঞানগুলি হারিয়ে ফেলেছে। অন্যকে সমস্যায় ফেলে, কুণ্ঠিত করে, ভয় দেখিয়ে, অপমান করেই ক্ষমতাবানেরা মজা লুটছেন। সমাজের প্রতিটি কোণে এই অসুখ ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

‘‘ক্যানসারই!’’ ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, প্রতিদিন বহু অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলছি আমরা। লোক দেখানো প্রতিবাদ করছি। অথচ যে বিষয়গুলিতে

প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেখানে সকলেই নীরব থাকছেন। সকলে প্রতিবাদ করতে ভয় পাচ্ছেন। নইলে বাসে বসে অমন হয়রানির শিকার হতে হতো না ওই ছাত্রীদের। রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করে ব্রততীর প্রতিক্রিয়া, ‘অন্যায় যে করে, আর, অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

social subsidence Public savagery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE