আমেরিকান সেন্টারের ৫৬ যদি তালিকার শীর্ষে থেকে থাকে, তা হলে হরিদেবপুরের ৩৫ অবশ্যই দ্বিতীয়। কিন্তু অপরাধীদের চরিত্রের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে ৩৫ বোধহয় ৫৬-কে পিছনে ফেলে দেবে! সৌজন্য, মুঙ্গেরি ‘মেশিন’-এর ঢালাও সরবরাহ।
১৯৯৩-এর ২১ জুলাই যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানে পুলিশ ৭৫ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। সেটা ছিল ‘সরকারি।’ লালবাজারের নথি অনুযায়ী, কলকাতার অপরাধ-ইতিহাসে দুষ্কৃতী-বন্দুকবাজির বহরের নিরিখে হরিদেবপুরের আগে রয়েছে শুধু মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে হামলা। ২০০২-এর ২২ জানুয়ারি সকালে সেখানে জঙ্গিরা ৫৬ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। মারা যান পাঁচ পুলিশকর্মী। ওই ঘটনাটিকে সরিয়ে রাখলে হরিদেবপুরের ধারে-কাছে কেউ নেই। পুলিশের হিসেবে বুধবার রাতে হরিদেবপুরের কবরডাঙায় দুষ্কৃতীরা নয় নয় করে ৩৫ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। প্রাণ গিয়েছে এক যুবকের।
কিন্তু দুয়ের মধ্যে ফারাক রয়েছে। অপরাধীদের চরিত্রগত ফারাক। কলকাতা পুলিশের কর্তাদের যুক্তি: আমেরিকান সেন্টারের সামনে গুলি চালিয়েছিল আফতাব আনসারিদের আসিফ রেজা কম্যান্ডো ফোর্স, যা কিনা পুরোদস্তুর একটি জঙ্গি সংগঠন। একে-৪৭ রাইফেল থেকে ৫৪ রাউন্ড, আর নাইন এমএম পিস্তল থেকে দু’রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। সেখানে হরিদেবপুরে গুলি চালিয়েছে যারা, তারা নিছক সাধারণ সমাজবিরোধী। খাস মহানগরের বুকে তাদেরই এ হেন ধুন্ধুমার বন্দুকবাজি দেখে লালবাজারের দুঁদে অফিসারেরাও বিস্ময় লুকোতে পারছেন না।
এবং ওঁদের অনেকে মনে করছেন, বরাহনগর থেকে বেহালা— কী পরিমাণ দেশি (ইম্প্রোভাইজড) অথচ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র (অপরাধজগতের ভাষায়, মেশিন) ও কার্তুজ দুষ্কৃতীদের হাতে মজুত রয়েছে, হরিদেবপুরই
তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এমতাবস্থায় তাঁদের আশঙ্কা, কলকাতায় যে কোনও দিন প্রকাশ্যে ‘গ্যাং ওয়ার’ বেঁধে যেতে পারে।
লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক সহকারী কমিশনার জানিয়েছেন, বুধবার রাতে কবরডাঙা মোড়ে মিনিট দশেকের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচটা স্বয়ংক্রিয়, ছোট মাপের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে মোট অন্তত ৩৫ রাউন্ড গুলি চলেছিল। অর্থাৎ, গড়ে এক-একটি থেকে অন্তত সাতটি বুলেট। ‘‘সমাজবিরোধীদের হাতে যত বন্দুক-বুলেট মজুত, আর তারা যে রকম বেপরোয়া, তাতে অবিলম্বে জোরদার অভিযান শুরু না-হলে কলকাতায় গ্যাং ওয়ার শুরু হবে। মুম্বইয়ে এক কালে মাফিয়া গোষ্ঠীদের মধ্যে যা নিয়মিত চলত।’’— পর্যবেক্ষণ ওই সিনিয়র অফিসারের।
পাশাপাশি দুষ্কৃতীদের হাতিয়ারের ধরন দেখেও আইনরক্ষকেরা শঙ্কিত। তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, হরিদেবপুরের ঘটনাস্থলে উদ্ধার হওয়া কার্তুজের খোলগুলি প্রাথমিক ভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, দুষ্কৃতীদের অধিকাংশের হাতে ছিল ৭.২ এমএম পিস্তল। এটি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। এক বার গুলি বেরোতে শুরু করলে পর পর দ্রুত ফায়ার হতে থাকে। প্রতি বার গুলি ভরতে হয় না। বিহারের মুঙ্গেরে তৈরি হয়ে এ রাজ্যে তা প্রচুর পরিমাণে ঢুকছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ‘‘মে মাসে কড়েয়ায় মহারাষ্ট্রের এক ব্যবসায়ীকে ৭.২ এমএম দিয়েই গুলি করা হয়েছিল। পুরভোটের দিন গিরিশ পার্কের সাব-ইন্সপেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকেও তা-ই।’’
বস্তুত গিরিশ পার্ক-কাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে একটি ৭.২ এমএম পিস্তল উদ্ধার করে। পরে অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারির পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে হানা দিয়ে তদন্তকারীরা যে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছিলেন, তার দু’টোই ৭.২ এমএম। ‘‘কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড এই পিস্তলে ছেয়ে গিয়েছে। সমাজবিরোধীর হাতে এখন সেভেন পয়েন্ট টু-ই বেশি।’’— মন্তব্য লালবাজারের এক কর্তার।
এ প্রসঙ্গে উঠে আসছে অপরাধ-জগতে হাতিয়ারের বিবর্তনের ছবিও। প্রবীণ অফিসারেরা জানাচ্ছেন, একটা সময়ে দুষ্কৃতীরা খুন-জখম বা ভয় দেখাতে মূলত ওয়ান শটার বা পাইপগান ব্যবহার করত, তিন-চার রাউন্ড চালিয়েই ভাবত, যথেষ্ট হয়েছে। পাণ্ডা গোছের কেউ হয়তো রিভলভার রাখত। নাইন এমএম পিস্তলধারী তো রীতিমতো ‘ডন’-এর মর্যাদা পেত। এক অফিসারের কথায়, ‘‘২০০৭-এর জানুয়ারিতে শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের নীচে এক ব্যবসায়ী নাইন এমএমের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান। স্থানীয় এক দাগির খোঁজ পড়ে। সে পরিষ্কার বলল, ওটা আমার কাজ নয়। আমার ও সব অটোম্যাটিক-ফ্যাটিক লাগে না। যা করেছি, সব ওয়ান শটার দিয়ে।’’
সেই পরিস্থিতি বেবাক বদলে গিয়েছে। গোয়েন্দাদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কৃতীদের মানসিকতাও পাল্টেছে। তাদের হাতে হাতে ফিরছে ৭.২ এমএমের মতো মুঙ্গেরি স্বয়ংক্রিয়। তা-ই কথায় কথায় ৩০-৩৫ রাউন্ড উগরে দেওয়াটাও এখন জলভাত।
প্রমাদ গুনছে পুলিশও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy