Advertisement
E-Paper

শহর জুড়ে ‘অরক্ষিত’ এটিএম, ঝুঁকি গ্রাহকেরই

এ যেন নিধিরাম সর্দার দিয়ে টাকার ভাণ্ডার আগলানোর চেষ্টা! তিন বছর আগে বেঙ্গালুরুতে এটিএমের ভিতরেই এক মহিলা গ্রাহককে ছুরি মেরে তাঁর তোলা টাকা নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। সেই ঘটনার পরে গ্রাহকদের নিরাপত্তায় জোরদার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০২:১৩

এ যেন নিধিরাম সর্দার দিয়ে টাকার ভাণ্ডার আগলানোর চেষ্টা!

তিন বছর আগে বেঙ্গালুরুতে এটিএমের ভিতরেই এক মহিলা গ্রাহককে ছুরি মেরে তাঁর তোলা টাকা নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। সেই ঘটনার পরে গ্রাহকদের নিরাপত্তায় জোরদার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটিএমে পাহারাদার বসানো। মঙ্গলবার রাতে দমদম এলাকায় মাত্র দু’কিলোমিটারের মধ্যে রক্ষী-বিহীন দু’টি এটিএমের ভল্ট কেটে প্রায় ৩৮ লক্ষ টাকা লুঠের ঘটনা ফের সামনে এনেছে সেই সুপারিশ মানার বিষয়টিকে। প্রশ্ন উঠেছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুপারিশ কতটা মেনেছে ব্যঙ্কগুলি।

বৃহস্পতিবার কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অনেক এটিএমেই রক্ষীর দেখা মেলেনি। কিছু জায়গায় পাহারাদার হিসেবে যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁরা নিজেরাই দুষ্কৃতী মোকাবিলায় নিজেদের পটুতা নিয়ে সন্দিহান। কারণ খাতায়-কলমে তাঁরা ‘সিকিউরিটি’ নন। তাঁরা ‘কেয়ারটেকার’। বছর তিনেক ধরেই এ ভাবে ‘নিরাপত্তা কর্মী’র নামে এটিএমগুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের লোক রাখার নমুনা দেখা যাচ্ছে। যা নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয় বলেই মত গ্রাহকদের।

মঙ্গলবার গভীর রাতে দমদমের ৭ ট্যাঙ্কস মোড়ে স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম এবং প্রাইভেট রোডে বন্ধন ব্যাঙ্কের এটিএমে গ্যাস কাটার দিয়ে ভল্ট কাটে দুষ্কৃতীরা। যা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ কাজ বলেই মনে করে পুলিশ। ফলে তাদের অনুমান, আগে থেকে ছক কষেই এই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। পুলিশকে ধোঁকা দিতে দু’টি এটিএমে সিসিটিভির সংযোগও কেটে দিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। রক্ষীবিহীন এটিএমে ওই ঘটনা চলাকালীন কোনও গ্রাহক এসে পড়লে তাঁর কী হাল হতো, ভেবেই আতঙ্কিত স্থানীয়দের অনেকে।

এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। সেভেন ট্যাঙ্কসের কাছে ওই এটিএমে গ্যাস কাটার বয়ে এনে তা দিয়ে অতক্ষণ ধরে ভল্ট কাটা হল— তার মধ্যে পুলিশকে কেন ওই জায়গায় টহল দিতে যায়নি, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। যেখানে এটিএমের হাত কয়েকের মধ্যেই পুলিশের কিয়স্ক ছিল। যদিও ঘটনার সময়ে এটিএম দু’টিতে পাহারাদার থাকলেও তাঁরা আদৌ দুষ্কৃতীদের মোকাবিলা করতে পারতেন কি না, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

এ দিন উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার বহু এটিএমের নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গিয়েছে, তাতে রাতে ডিউটি করতে ভয় পান অনেকে। কারণ দুষ্কৃতী-মোকাবিলার জন্য অস্ত্রশস্ত্র কিছুই থাকে না তাঁদের সঙ্গে। এমনকী, ন্যূনতম লাঠিও থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।

তা হলে কোনও গ্রাহককে বিপদে পড়তে দেখলে কী করবেন তাঁরা? বি টি রোডের অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের নিরাপত্তা কর্মী কৃষ্ণধন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ পর্যন্ত তেমন পরিস্থিতি হয়নি। তবে যদি সত্যিই তেমন কিছু হয়, সে ক্ষেত্রে এটিএম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশকে ফোন করতে হবে। আর আমি যে সংস্থায় চাকরি করি, সেখানে জানাতে হবে।’’ অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ বিপদ ঠেকানো যাবে না। বিপদের পরে যা হয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কী সেই ব্যবস্থা? বিমার সুবাদে এটিএম থেকে ডাকাতি হওয়া টাকার ক্ষতিপূরণের পাকা ব্যবস্থা রয়েছে ব্যাঙ্কের। যে এটিএমগুলি ব্যাঙ্ক সরাসরি দেখে না, সেগুলির দেখভাল ও নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা দেয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে। বিমা করা থাকে তাদেরও।

স্টেট ব্যাঙ্কের বেঙ্গল সার্কেলের চিফ জেনারেল ম্যানেজার প্রশান্ত কুমার বলেন, ‘‘আমাদের পরিচালিত ১৩০০ এটিএমেই নিরাপত্তা রক্ষী রয়েছে। ওই সব এটিএমে বৈদ্যুতিন নজরদারি ব্যবস্থাও (ই-সার্ভিল্যান্স) রয়েছে। কিন্তু যে ১৭০০টি এটিএম ভেন্ডারদের হাতে দেওয়া আছে, তার কোনও দায়িত্ব আমাদের নয়।’’

প্রশান্তবাবুর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ওই সব এটিএম থেকে টাকা লুঠ হলে বিমা সংস্থার থেকে তা ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু এটিএমে টাকা তুলতে গিয়ে গ্রাহক যদি দুষ্কৃতী-হামলার মুখে পড়েন, তার দায় তাঁদের নয়। একই কথা জানিয়েছে এটিএমের বরাত পাওয়া সংস্থাগুলিও। সেভেন ট্যাঙ্কসের এসবিআই এটিএমটি তেমন এক সংস্থাকে বরাত দেওয়া আছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ। ব্যাঙ্ক বা ভেন্ডারদের এ হেন মানসিকতার জেরেই এটিএমগুলি অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাহকদের জন্য সুরক্ষিত নয় বলে মত ঠিকাদার সংস্থার কর্মীদের।

রাজ্যের ব্যাঙ্কিং সেক্টর ঠিকাদার কর্মী সংগঠনের উত্তর ২৪ পরগনার সভাপতি কমল চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘ভেন্ডার সংস্থাগুলি মুনাফা বাড়াতে লোক কমিয়ে দিচ্ছে। এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক ১৬০০ কর্মী সঙ্কোচনের নির্দেশিকা দিয়েছে। তাই এটিএমে লোক নেই।’’ রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি— দু’ধরনের ব্যাঙ্কই ক্রমশ এটিএমের নিরাপত্তারক্ষী কমাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক সুদীপ্ত সাহা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বিভিন্ন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা আইবিএ-র সুপারিশের উল্টো পথে হেঁটে ক্রমশ এটিএমের নিরাপত্তা রক্ষী কমাচ্ছেন।’’

কলকাতা পুলিশের দাবি, এ ধরনের অব্যবস্থা নিয়ে একাধিকবার ব্যাঙ্কগুলিকে সতর্ক করেও লাভ হয়নি। এক কর্তার কথায়, ‘‘ব্যাঙ্কের নিজেদের বিমার ব্যবস্থা রয়েছে বলেই গ্রাহকের দিকটা নিয়ে ভাবে না।’’ ফলে সুরক্ষার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অবস্থাটা ভাগের মায়ের মতো বলেই মত অনেকের।

নিরাপত্তার অভাব যে গ্রাহকদের প্রতিদিন কতটা ভোগাচ্ছে, তার নজির এ দিন মিলেছে কলকাতার এটিএমগুলিতেই। যেমন, ভিতরে নিরাপত্তা কর্মী না থাকায় গ্রাহককে সমস্যায় পড়তে দেখা গিয়েছে গড়িয়াহাট রোডে এসবিআই-এর বালিগঞ্জ শাখার ই-কর্নারে। অগত্যা টাকা তুলতে এসে সমস্যায় পড়ে সাহায্যের জন্য অপরিচিত ব্যক্তিকে ভিতরে ডেকে এনেছেন এক ব্যক্তি। যেখানে কাউন্টারের ভিতরে একটি যন্ত্রের সামনে দুই অপরিচিতের একসঙ্গে দাঁড়ানোর কথাই নয়।

বাগবাজারের রাস্তায় এ দিন দুপুরে জটলা চলছিল। আলোচনার বিষয় বুধবারের এটিএম ভাঙার ঘটনা। শোনা গেল, স্থানীয় ইউবিআই-এর একটি এটিএমে এক দিন ভল্ট খুলে গিয়েছিল। স্থানীয়েরা ঢুকে দেখেন যন্ত্রের ভিতর থেকে থরে থরে সাজানো ৫০০ টাকার গোছা উঁকি মারছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ঘটনাটি পাশেই ইউবিআই অফিসে গিয়ে জানান। তা সত্ত্বেও অবশ্য সেই এটিএমে আজ পর্যন্ত কোনও নিরাপত্তা কর্মী নেই। এ দিন দুপুরেও নজরদারি-হীন ভাবেই দেখা গিয়েছে এটিএমটিকে।

সোদপুর স্কুলপাড়া টিয়ার মোড়ে একটি এটিএমে গত ৩১ ডিসেম্বর সামনের কাচ ভেঙে ফেলা হয়। মত্ত যুবকেরা ওই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। এ দিনও কাচভাঙা অবস্থাতেই দেখা মিলেছে এটিএম-টির।

তথ্য: প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী, প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়

Thief ATM Sodepur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy