Advertisement
১৭ মে ২০২৪

নোটের গেরো, বাজারে বাড়ন্ত শীতের সব্জি

মন খারাপ আসগর কাজীর। বড্ড বেশি মন খারাপ বলেই শুক্রবার ভরদুপুরে ব্যবসার সময়ে কোলে মার্কেটের আরত ছেড়ে ভাত ঘুম দিতে চলে গিয়েছেন নিমাই মণ্ডলও। কেন? কারণ ওঁদের কাছে টাকা আছে।

এমন দৃশ্য ফিরবে কবে? — ফাইল চিত্র

এমন দৃশ্য ফিরবে কবে? — ফাইল চিত্র

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫৯
Share: Save:

মন খারাপ আসগর কাজীর। বড্ড বেশি মন খারাপ বলেই শুক্রবার ভরদুপুরে ব্যবসার সময়ে কোলে মার্কেটের আরত ছেড়ে ভাত ঘুম দিতে চলে গিয়েছেন নিমাই মণ্ডলও। কেন? কারণ ওঁদের কাছে টাকা আছে। কিন্তু সেই টাকা এখন অচল। ভিন্‌ রাজ্যের কোনও এজেন্ট পুরনো টাকা নিচ্ছেন না। ফলে শীতের মরসুমে গত বছরও যেখানে আসগরদের আরতে লাল টকটকে বিট, টাটকা গাজর, সবুজ মিষ্টি দানার মটরশুঁটির বস্তা গড়াগড়ি খেয়েছে, এ বার সেখানে রাঁচির আলু ছাড়া কিছুই নেই। গাজর বা মটরশুঁটি নিলামের ডাকও দিতে হচ্ছে না আসগরদের। তাই মন খারাপ আসগর, নিমাই, সুলতানদের মতো আরতদারদের।

আসগরই বলছিলেন, অন্য বছর শীত পড়ার কিছু দিন আগেই বাজারে বিট, গাজর, মটরশুঁটি চলে আসে। দিনে অন্তত ৮-১০ লরি মাল এসে যায়। এ বছর? ওঁর কথায়, শুক্রবার গাজর আর মটরশুঁটি এসেছে মাত্র এক গাড়ি করে! আসগর বলেন, ‘‘ব্যবসা চলবে কী করে? টাকা নেই। তাই শুধু আলু নিয়ে বসে আছি।’’

পাইকারি বাজারে শীতের সব্জির আকাল বলে খুচরো বাজারে দামও অত্যাধিক চড়া। এ দিন কলকাতার বিভিন্ন বাজারে মটরশুঁটি বিক্রি হয়েছে ১৫০-২০০ টাকা কেজি দরে। তা-ও খুব টাটকা নয়। মাটি-সহ ধূসর লাল নাসিকের মোটা গাজর ৬০-৮০ টাকার উপরে। মরসুমি বিট তো এখনও শহরবাসী দেখতেই পাননি।

কোলে মার্কেটের আরতদারদের বক্তব্য, কবে বাজার স্বাভাবিক হবে, তা জানা নেই। টাকা জমা দিতে গেলে একটা দিন নষ্ট। আবার নেট ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠালে, এজেন্ট ২৪ হাজার টাকার বেশি ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারবে না। মাল পাঠাবে কী করে! এক আরতদারের কথায়, ‘‘শীতের সব্জি কেনার জন্য আগে থাকতেই ঘরে নগদ কয়েক লক্ষ টাকা জোগার করে রেখেছিলাম। এখন সেই টাকা নিয়ে বসে আছি। কোনও কাজে লাগছে না।’’

কলকাতার বাজারে সাধারণত গাজর আসে দিল্লি ও হরিয়ানা থেকে। তার সঙ্গে রাজ্যেরও কিছু ফসল থাকে। ওই ধরনের লম্বা, লাল মিষ্টি গাজরের চাহিদা ভালই থাকে । এ ছাড়াও মাথায় গাছ-সহ ছোট্ট লাল টুকটুকে পাহাড়ি গাজর আসে শিলং ও ভুটান থেকে। সেগুলিরও কলকাতার বাজারে বেশ কদর। মিষ্টি দানার মটরশুঁটি শহরে আসে দার্জিলিং, রাঁচি, বেনারস থেকে এবং বিটের লাগাতার জোগান দিয়ে যায় বেঙ্গালুরু। বরফের চাদরে শুয়ে শীতের ধনেপাতা আসে রাঁচি, হাজারিবাগ থেকে।

সূত্রের খবর, এক-একটি ট্রাকে কমপক্ষে ১০-১৫ লক্ষ টাকার গাজর, মটরশুঁটি থাকে। সেই পণ্য কোলে মার্কেটে আসার পরে নিলাম ডেকে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়। খুচরো বিক্রেতাদের হাত ধরে সেই পণ্য ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার ছোট, বড় বাজারগুলিতে। ৫০০, ১০০০ টাকার নোট অচল হয়ে যাওয়ার কারণে ট্রাক আসা বন্ধ। ফলে শীতের মরসুমে বাঙালির ঘরে এখনও মটরশুঁটি দিয়ে বাঁধাকপি রান্নার কথা শোনা যাচ্ছে না। বরং দাম শুনে প্রায় পালাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

এ দিন কোলে মার্কেটে গিয়ে দেখা গেল, বহু ক্রেতাই গাজর, মটরশুঁটি, বিটের খোঁজ করছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় মাল রয়েছে সামান্য। দামও বেশ চড়া। শুক্রবার পাইকারি বাজারে মটরশুঁটির দর গিয়েছে ৮০-৯০ টাকা কেজি। গাজর কেজি প্রতি ৪০-৬০ টাকা। বিটের দেখা মেলেনি। বিনসও নামমাত্র। পুরনো ৫০০, ১০০০ টাকার নোট নেওয়া হচ্ছে না। তাই সামর্থ মতো সামান্য জিনিস নিয়েই বিক্রেতারা ফিরছেন নিজের বাজারে।

চাকরি সূত্রে প্রায় ৪০ বছর কোলে মার্কেটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে উত্তম মুখোপাধ্যায়। বর্তমান বাজারের হাল-হকিকত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ভিন্‌ রাজ্যের এজেন্টরাই এখন সব। তাঁরাই ভিন্‌ রাজ্যের যাবতীয় পণ্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। দামও ঠিক করেন। তাঁদের কথা মতোই এখন আরতদারদের চলতে হয়। তাঁর কথায়, এখন ব্যবসাটা হয়ে গিয়েছে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেলে’র মতো। তাই নোট ইস্যুতে বিপদে পড়ে গিয়েছেন আরতদারেরা। টাকা থাকলেও, মাল কিনতে পারছেন না।

বাজার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বছর দশেক আগেও কোলে মার্কেটের ব্যবসার চরিত্র অন্য রকম ছিল। বড় বড় আরতদারেরা সরাসরি চাষিদের ঘরে গিয়ে সব্জি কেনার টাকা অগ্রীম দিয়ে চলে আসতেন। তাতে চাষে লাভ-ক্ষতির সব দায়ই নিতেন আরতদার। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, শিলং এমনকী ভুটানে গিয়েও টাকা দিয়ে আসা হত। খেতের ফসল ঘরে উঠলে, চাষিরা সেই মাল আরতদারের কাছে পাঠিয়ে দিত। বিশ্বাসই ছিল সেই লেনদেনের মূল ভিত। দেশ জুড়ে বাজার অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থই এখন ব্যবসার মূলধন। আর সেই মূলধনই এখন অচল। ফলে কলকাতার তাপমাত্রা নামতে নামতে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এলেও, ভিন্‌ রাজ্যের মরসুমি ফসলের দেখা নেই বাজারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Winter vegetables Market
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE