Advertisement
২৪ মার্চ ২০২৩
New Born

মস্তিষ্কের জটিল অস্ত্রোপচারে নতুন জীবন পেল দু’মাসের শিশু

যা দেখে টানা দু’মাস শুধু চোখের জল ফেলেছেন হাওড়ার মুন্সিরহাটের বাসিন্দা আনোয়ারা মল্লিক।

অস্ত্রোপচারের পরে মায়ের কোলে । নিজস্ব চিত্র

অস্ত্রোপচারের পরে মায়ের কোলে । নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৫৭
Share: Save:

ছেলেকে কোলে পেয়েই কেঁদে ফেলেছিলেন তরুণী মা। সদ্যোজাত শিশুটির কপালের কাছ থেকে টিউমারের মতো দেখতে বিশাল একটি মাংসের থলি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যার চাপে দুটো চোখ প্রায় বন্ধ। চিকিৎসক ও পরিজনদের কাছে বার বার তিনি জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘‘ছেলের কী হয়েছে? ও কি দু’চোখ খুলে আমাকে দেখবে না!’’

Advertisement

বড় সেই মাংসের থলির ভারে সারা ক্ষণ কাঁদত শিশুটি। যা দেখে টানা দু’মাস শুধু চোখের জল ফেলেছেন হাওড়ার মুন্সিরহাটের বাসিন্দা আনোয়ারা মল্লিক। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিলেও লুকিয়ে চোখের জল ফেলতেন সেলাই যন্ত্রের মিস্ত্রি মুজাফ্ফর মল্লিক। অবশেষে ছ’ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে দু’মাসের শিশুটিকে স্বাভাবিক জীবনে আসার সুযোগ করে দিলেন এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। হাওড়ার ওই দম্পতি এখন বলছেন, ‘‘এ বার স্বস্তি পেলাম।’’

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আলামিন মল্লিক নামের ওই শিশুটি ‘ফ্রন্টো নেজ়াল এনসেফ্যালোসিল’-এ আক্রান্ত ছিল। খুলির সামনের অংশ ও নাকের উপরিভাগের সংযোগস্থলের হাড় না থাকায় সেখানে একটি বড় ফাঁক তৈরি হয়ে মস্তিস্কের বিভিন্ন টিসু (কোষ), জল ওই মাংসের থলির মাধ্যমে জন্মগত ভাবেই বাইরে বেরিয়ে আসে। আলামিনের অস্ত্রোপচার করা শিশু স্নায়ু শল্য চিকিৎসক কৌশিক শীলের কথায়, ‘‘সাধারণত মাথার পিছনে এমন হয়। কিন্তু পাঁচ হাজার শিশুর মধ্যে এক জনের সামনের দিকে এমন সমস্যা দেখা দেয়।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, গর্ভস্থ অবস্থায় যখন ভ্রূণের শারীরিক বিকাশ ঘটে, তার প্রথম দু’মাসের মধ্যেই মস্তিস্ক তৈরি হয়। সেই সময়েই জন্মগত কোনও ত্রুটি হলে মস্তিস্ক বা শিড়দাঁড়ায় এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। দ্রুত অস্ত্রোপচার করে ওই থলি বাদ না দেওয়া হলে যে কোনও সময়ে তা ফেটে বিপদের আশঙ্কা থাকে।

আরও পড়ুন: গত ২৪ ঘণ্টায় ২০ করোনা আক্রান্তের মৃত্যু, নতুন করে সংক্রমিত ৭৮৭

Advertisement

আরও পড়ুন: দুয়ারে সরকারে নাম নথিভুক্তি পৌঁছে গেল ২ কোটিতে, শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

কৌশিকবাবু জানাচ্ছেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের ট্যাবলেট নিয়মিত না খাওয়াটাই এই সমস্যার বড় কারণ। অনেকেই অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার প্রায় দু’-তিন মাস পরে তা বুঝতে পারেন। ফলে যখন তিনি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ফলিক অ্যাসিড খাওয়া শুরু করছেন, তত দিনে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। যেমন হয়েছিল আনোয়ারার ক্ষেত্রেও। তাঁর কথায়, ‘‘অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার প্রায় তিন মাস পরে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারি। তার পরে লকডাউনের জন্য ঠিকমতো চিকিৎসকের কাছে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও যেতে পারতাম না।’’

গত অক্টোবরে বড়গাছিয়ার নার্সিংহোমে জন্মানোর এক দিন পরে আলামিনকে এসএসকেএমে নিয়ে আসেন পরিজনেরা। মুজাফ্ফর বলেন, ‘‘সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও ছেলের বয়স মাত্র দু’দিন হওয়ায় চিকিৎসকেরা পরে আসতে বলেন। ওঁরা ফোনে খবর নিতেন। ডিসেম্বরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফোন করে ডেকে ছেলেকে নিওনেটোলজি বিভাগে ভর্তি করেন।’’ শিশু স্নায়ু শল্য চিকিৎসক কৌশিক শীল, সদ্যোজাত ও শিশু শল্য চিকিৎসক দীপঙ্কর রায়, শুভঙ্কর চক্রবর্তী, সুমন দাস, প্লাস্টিক সার্জন গৌতম গুহ, অ্যানাস্থেটিস্ট প্রবীর দাস, গৌতম পিপলাই-সহ মোট ন’জনের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয় অস্ত্রোপচারের জন্য।

গত ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত চলে অস্ত্রোপচার। চিকিৎসকেরা জানান, অস্ত্রোপচারের পরে মস্তিষ্কে জল জমে যায়। সেটিকে পেটে পাঠাতে প্রথমে শিশুটির মাথার ভিতরে একটি পাইপ বসানো হয়। এর পরে মস্তিষ্ক ‘ওপেন’ করে যে সমস্ত টিসু বেরিয়ে ছিল, তা বাদ দিয়ে নাক ও খুলির সংযোগস্থলের ফাঁকা জায়গায় একটি হাড় প্রতিস্থাপন করা হয়। এর পরে প্লাস্টিক সার্জন নাকের দিক থেকে ‘ওপেন’ করে টিসুর অপর দিকের অংশ কেটে বাইরে বার করে অস্ত্রোপচার করেন। চিকিৎসকেরা জানান, ওই টিসুগুলি বাদ দিলেও কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ সেগুলি নিষ্ক্রিয় ছিল। শিশুটি র ওজন ছিল ২ কেজি ২০০ গ্রাম। তার অর্ধেক ছিল ওই থলির ওজন। ফলে কম ওজন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, শরীরের তাপমাত্রা নেমে যাওয়া ও অস্ত্রোপচারের টেবিলে মাথার অবস্থান ঠিক রাখা— অস্ত্রোপচারের সময়ে এই সমস্ত ঝুঁকি কাটাতে হয়েছে বলেই জানাচ্ছেন হাসপাতালের স্নায়ু শল্য চিকিৎসা বিভাগের প্রধান শুভাশিস ঘোষ।

এখন নিজের মুখেই খাচ্ছে আলামিন। আর তিন-চার দিনের মধ্যেই তাকে ছুটি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন চিকিৎসকেরা। কৌশিকবাবু জানান, আগামী দিনে বুদ্ধির বিকাশ বা অন্য কোনও সমস্যা না হলেও তিন-চার বছর বয়স পর্যন্ত স্নায়ু বিকাশ ক্লিনিকের পর্যবেক্ষণে থাকবে আলামিন। মায়ের কোলে গেলেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে হেসে উঠছে সে। আর তা দেখে হেসে ফেলছেন আনোয়ারাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.