পোষ্য-বন্ধু সেই ক্যাফে।
ক্যাফেতে বসে অর্কর সঙ্গে গল্প করছিলেন রুক্মিণী। সামনের প্লেটে রাখা স্যান্ডউইচ। আর সোফায় রুক্মিণীর কোল ঘেঁষে বসে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে সাদা-কালো মেশানো তুলতুলে সারমেয় স্যিৎজু।
ঠিক তার পিছনের টেবিলেই ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া সারছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের বিনোদ কুমার। শুধু এটুকু বললে ছবিটায় ফাঁক থেকে যায়। সোফায় বসে আর একটা প্লেটে ডগ-ফুডে মুখ ডুবিয়ে খেতে ব্যস্ত পাগ প্লুটোও।
খাতায়-কলমে নিউ আলিপুরের পুষ্যি-বন্ধু এই ভোজশালা আসলে একটা ‘পেট-ফ্রেন্ডলি ক্যাফে’। নাগরিক জীবনের চাহিদা মেনে দুনিয়ার বড় শহরগুলিতে যার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এ দেশেও দিল্লি, মুম্বই বা বেঙ্গালুরুর পথ ধরে হাঁটছে কলকাতা। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে এসেছেন নিউ আলিপুরের দুই বন্ধু শ্রুতি ও অঙ্কুশ। শ্রুতি বলছিলেন, ‘‘আমার পোষা পাগটাকে বাড়িতে রেখে কোথাও গেলে ওর জন্যই মনটা পড়ে থাকত। তখনই মনে হল, শহরের পাবলিক-স্পেসে ওদের কেন ঠাঁই মিলবে না।’’
শ্রুতি-অঙ্কুশদের ক্যাফেতে পুষ্যি কুকুর নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। মেনুতেও নানা কিসিমের ‘ডগ-ফুড’ থাকছে। ছিমছাম কাফেটির নিজস্ব সারমেয়-বাহিনী রয়েছে। লাসা, ককার স্প্যানিয়েল, গোল্ডেন রিট্রিভার, সাইবেরিয়ান হাস্কি— এমন ন’টি চারপেয়ে। ক্যাফেতে ঢোকার মুখে ঘেরা একটা খোপে খেলে বেড়াচ্ছে তারা। অতিথিদের সঙ্গে আসা কুকুরদের সঙ্গেও মাঝে মধ্যে ভাব জমে যাচ্ছে ক্যাফের পোষ্যদের। রাজারহাট থেকে আসা কলেজপড়ুয়া অনুষ্কার ল্যাব্রাডর ক্লারা যেমন এক জোড়া লাসার সঙ্গে সহজেই আহ্লাদিপনায় মজলো।
সঙ্গে নিয়ে যান পোষ্যকেও। শহরে চালু নয়া রেস্তোরাঁ।
বছর তিনেকের পাগ প্লুটোর ‘মানুষ-বাবা’ বিনোদ কুমার বলছিলেন, ‘‘প্লুটো পরিবারে আসার পর আমার স্ত্রী বেরোনো বন্ধই করে দিয়েছিলেন। কত দিন পর আমরা একসঙ্গে বেরোলাম। আর প্লুটোরও একটু বেড়ানো হল।’’
মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের মতে, এই ধরনের পরিসর গড়ে ওঠাটা শহরের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক। তাঁর কথায়, ‘‘পোষ্য সঙ্গ মানসিক চাপ কাটাতে সাহায্য করে। শহুরে জীবনের ক্লান্তি কাটিয়ে মন হাল্কা করতে এমন ক্যাফে সাহায্য করবে।’’ যাঁদের নিজেদের পুষ্যি নেই, কিন্তু কুকুর ভালবাসেন, তাঁরাও কলকাতার এই ক্যাফেতে কুকুরদের সঙ্গে সময় কাটাতে স্বাগত। কুকুরপ্রেমী অভিনেত্রী তথা বিধায়ক দেবশ্রী রায় এই অভিনব উদ্যোগের মধ্যে শহরের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ছাপ দেখছেন। তিনি বললেন, ‘‘যে কলকাতায় মাসখানেক আগেই বিষ দিয়ে কুকুরদের মেরে ফেলার অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে, সেখানে এমন উদ্যোগ তো দারুণ বলতে হবে।’’
তবে এ শহরে এখনও কিছু খামতি থেকে যাচ্ছে। যেমন কুকুরদের নিয়ে ক্যাফে-বিলাসের পরিবেশ গড়ে উঠলেও বেড়াল বা পাখিপ্রেমীদের মন খারাপ হতে পারে। কলকাতার এই ক্যাফেতে এখনও পর্যন্ত সব ধরনের পুষ্যি নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। তবে শ্রুতি বলছেন, ‘‘একটু সবুর করুন! ব্যবস্থা হচ্ছে। আপনার বাড়ির বেড়াল, খরগোশ, মাছও সঙ্গে আনতে পারবেন।’’
যে কোনও ‘পেট-ফ্রেন্ডলি ক্যাফে’তে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন, ‘ফ্ল্যাশ’ দিয়ে কোনও পুষ্যির ছবি তোলা যাবে না। ক্যাফের পুষ্যিদের সঙ্গে খেলার আগে অবশ্যই ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ দিয়ে হাত সাফ করে নিতে হবে। আর আপনি নিজের পুষ্যি নিয়ে গেলে সঙ্গে রাখতে হবে তার টিকাকরণের শংসাপত্র বা ‘ভ্যাকসিনেশন কার্ড’। আর কুকুরকে নিয়ে যেতে হবে ‘লিস’ পরিয়ে, যাতে চারপেয়েদের মধ্যে কোনও দক্ষযজ্ঞ না বেধে যায়।
তবে কলকাতায় চারপেয়ে বন্ধুদের কথা ভেবে ‘পাবলিক-স্পেস’ তথা ক্যাফে-রেস্তোরাঁ ঢেলে সাজানোর চেষ্টা এখনও খুব বেশি নয়। বিষয়টি নিয়ে হেলদোল নেই অনেকেরই। দক্ষিণ কলকাতায় জনপ্রিয় একটি খোলা ছাদের কাফের কর্তা অনির্বাণ সেনগুপ্ত অবশ্য বলছেন, ‘‘আমাদেরও পুষ্যিদের নিয়ে কিছু করার ইচ্ছে ছিল। গোড়ায় খানিকটা ভেবেওছিলাম। কিন্তু ঠিকঠাক জায়গার অভাবে ব্যাপারটা হয়ে ওঠেনি।’’ তবে কলকাতার ছবিটা যে অবশেষে পাল্টাতে শুরু করেছে তাতে খুশি চিত্রপরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নিজের পুষ্যিকে নিয়ে তিনি এমন জায়গায় যেতেও চান। কৌশিকের কথায়, ‘‘মা দুগ্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশদের বাহনকে এত গুরুত্ব দেয় বাঙালি। তাই শহরের ক্যাফে-রেস্তোরাঁয় পুষ্যিদের ব্রাত্য থাকা মোটেও ভাল নয়।’’
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy