Advertisement
১১ মে ২০২৪

নবমীতেই শুরু পরের পুজো

এ পুজো অষ্টমীতে শেষ! আবার নবমীতে শুরু। দুর্গাপুজোর মধ্যেই আর এক পুজো! এ পুজো পুরস্কারের। ফি বছর নবমীর সকাল থেকেই ক্লাবে ক্লাবে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। অনেক জায়গায় সন্ধ্যার মধ্যেই পরের বছরের জন্য শিল্পীকে বায়নার কাজ শেষ। একাদশীতেই আবার কোনও কোনও ক্লাব ভিন্‌ রাজ্যে দল পাঠিয়ে দেয় থিমের রসদ জোগাড়ে!

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

এ পুজো অষ্টমীতে শেষ! আবার নবমীতে শুরু।

দুর্গাপুজোর মধ্যেই আর এক পুজো! এ পুজো পুরস্কারের।

ফি বছর নবমীর সকাল থেকেই ক্লাবে ক্লাবে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। অনেক জায়গায় সন্ধ্যার মধ্যেই পরের বছরের জন্য শিল্পীকে বায়নার কাজ শেষ। একাদশীতেই আবার কোনও কোনও ক্লাব ভিন্‌ রাজ্যে দল পাঠিয়ে দেয় থিমের রসদ জোগাড়ে!

এত তাড়া কীসের?

পুজো উদ্যোক্তারা বলছেন, আগে উত্‌সব শুধু উত্‌সবেই আটকে ছিল। হইহই করে পুজো করা, দল বেঁধে ফূর্তি এ সব নিয়েই কাটিয়ে দিতেন পুজোকর্তারা। পুরনো পাড়ার পুজোয় যোগ দিতে প্রবাসী কর্তা সপরিবার মধ্য কলকাতার হোটেলে ঘর নিয়েছেন, এ শহর এমন দৃশ্যও দেখেছে। এখন সেই ধাঁচ পুরো বদলে গিয়েছে, এমনটা বলা যায় না। তবে সময়ের হাত ধরেই পুজোর অনেকটা জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট সংস্কৃতি, সেরা পুজোর পুরস্কার।

শহরের প্রবীণ পুজোকর্তারা বলেন, আগে নামী পুজোর বিচার করা হত মণ্ডপে জমা হওয়া ভিড় দিয়ে। রেকর্ড ভিড় টেনেই উঠে এসেছিল সাবেক কলকাতার বিভিন্ন স্কোয়ার, পার্কের পুজো। এমনকী, বছর পনেরো আগেও নিউ আলিপুর, বেহালার পুজোগুলিও ভিড় টেনেই শিরোনামে এসেছিল। “এখন অবশ্য সেরা বিচার হয় পুরস্কারের ঝুলি দেখে। ষষ্ঠীর রাতে আনন্দবাজার শারদ অর্ঘ্যের মতো নামী পুরস্কার কারা পেল, তা দেখেই মণ্ডপে ভিড় জমান সাধারণ মানুষ,” বলছেন কলকাতার এক পুজোকর্তা।

এই পুরস্কারই শুরু করে দেয় পরের বছরের প্রস্তুতি। কোন শিল্পী ক’টা পুরস্কার পেলেন, কার ভাঁড়ার একেবারেই খালি এ সব নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণে মেতে ওঠেন পুজো উদ্যোক্তারা। ফুটবল ময়দানের জীবন-পল্টুর ঢঙেই নতুন খেলোয়াড় তুলতে ময়দানে ঝাঁপানো শুরু করেন পুজো ময়দানের ক্লাবকর্তারা। দশমীর সকালেই মিষ্টির হাঁড়ি-টাকা নিয়ে সটান শিল্পীর বাড়িতে হাজির হন ক্লাবকর্তারা। “বৌদি, দাদা কিন্তু এ বার আমাদের ক্লাবেই”, এই বাক্যবাণে শিল্পী ধরে নেওয়াও এই শহরের বিরল দৃশ্য নয়। আবার পুরস্কার না পেলে দু’সপ্তাহ আগে মাথায় তুলে রাখা শিল্পীকে ভুলে যেতেও বেশি সময় লাগে না পুজোকর্তাদের।

২০১২-র অষ্টমী। ভাল গোত্রের এক শিল্পীকে দিয়ে কাজ করিয়েও সে বার পুরস্কারের ঝুলি প্রায় ফাঁকাই ছিল উত্তর কলকাতার এক পুজো কমিটির। মণ্ডপের সামনে দুই পুজোকর্তার চোখ ছলছল। এক জন বললেন, “এই শিল্পীর হাত ধরেই তিন বছর আগে রেকর্ড ভিড় টেনেছিলাম। সব পুরস্কারই ঘরে ঢুকেছিল। আর এ বার কেউ ফিরেই তাকাল না!” দশমীর সকালেই পরের বছরের শিল্পীকে অগ্রিম টাকা দিয়ে বায়না করে ওই পুজো কমিটি।

ওই বছরই নবমীর রাতে হাতিবাগানের এক পুজোকর্তার মুখে চওড়া হাসি। তিনি এক স্পনসরের সঙ্গে বাজি ধরেছিলেন, পনেরোটার বেশি পুরস্কার পেলে চুক্তির দ্বিগুণ টাকা নেবেন। ছোট-মাঝারি-বড় মিলিয়ে একুশটি পুরস্কার ঢুকেছিল ওই পুজো কমিটিতে। বাজি জিতে টাকাও পেয়েছিল পুজো কমিটি। “পুরস্কারের মহিমা এমনই,” বলছেন হাতিবাগানের ওই পুজোকর্তা। পুরস্কারের মহিমায় আচ্ছন্ন রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীও। আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ক্লাব, নিউ আলিপুরের সুরুচি সঙ্ঘ পুরস্কারের ডালি সাজাতে ক্লাববাড়ির এক তলায় দেওয়াল-জোড়া গ্যালারি বানিয়ে ফেলেছে।

পুরস্কারের এই মহিমার কারণও অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন পুজো ময়দানের লড়াকু নেতারা। তাঁরা বলছেন, গত কয়েক বছরে পুজো বাজারে পুরস্কার একটা সম্মানের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। কোন ক্লাব কত পুরস্কার পেল, তা দিয়েই চলে জাত-বিচার। “পুরস্কারের মধ্যেও ছোট-বড় আছে। বড় ব্যানারের পুরস্কার পেলে সে পুজোর জাতই আলাদা। ছোট সংস্থার পুরস্কারকে আবার তেমন গুরুত্ব দেন না অনেকে,” বলছেন সন্তোষপুর লেকপল্লির পুজোকর্তা সোমনাথ দাস।

পুরস্কারের মহিমা রয়েছে বাজার ধরতেও। পুজো পুরস্কার থেকে একটা আর্থিক লাভ তো থাকেই, কিন্ত আসল লাভটা থাকে পরের বছরের স্পনসর জোগাড়ে। দক্ষিণ শহরতলির হরিদেবপুর অজেয় সংহতির কর্তা হিল্লোল বসু বলছেন, কোন পুজো ক’টা পুরস্কার পেয়েছে, তার উপরে ভর করেই পুজোয় টাকা ঢালেন কর্পোরেট কর্তারা। কোনও কোনও পুজোর কপাল এতটাই চওড়া যে পুরস্কারের দৌলতে বছর-বছর স্পনসর উপচে পড়ে তাদের। উত্তর কলকাতার টালা বারোয়ারির পুজোকর্তা অভিষেক ভট্টাচার্যের কথায়, “কোনও কোনও পুরস্কারে আর্থিক মূল্য কম। কিন্তু স্পনসরের ঘরে তার দাম কয়েক লক্ষ টাকার সমান।”

এ যেন কার্যত গড়ের মাঠের গল্প। ট্রফি জিতলে শিল্পীকে মাথায় তুলে রাখে ক্লাব। অন্য ক্লাবে দর বাড়ে। ট্রফি জিতলে অনায়াসে স্পনসরের টাকা চলে আসে। আর না পেলে?

ঠিক ময়দানের তাঁবুর মতোই অন্ধকার নেমে আসে পুজো কমিটির ঘরে। অষ্টমীর সন্ধ্যাতেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE