Advertisement
১১ মে ২০২৪

ছুটিতে যে কোথা দিয়ে মায়াবিভ্রম তৈরি হয়!

এইসব রোম্যান্টিক বিলাসিতায় সারা বছর কাটিয়ে প্রতি শীতে উড়ে আসি কলকাতায়। বিমান যখন নামে, এক পাগলাটে ঘোলাটে বাতাসে ফুসফুসটা যেন হাল্কা লাগে। চোখে রং লাগে। বাড়িতে অপেক্ষায় কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুর দম, ট্যাক্সিওয়ালাকে বলি, ‘‘একটু জোরে চালান না দাদা!’’

স্তব্ধ: যানজটে থমকে শহর। মৌলালি মোড়ে। ফাইল চিত্র

স্তব্ধ: যানজটে থমকে শহর। মৌলালি মোড়ে। ফাইল চিত্র

ভ্রমর মুখোপাধ্যায় (মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা)
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:২২
Share: Save:

কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা। অনেকটা রুশ দেশের মাত্রুশকা পুতুলের মতো। ২৩ বছর বয়সে কলকাতা ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করতে চলে গিয়েছিলাম। সেই কাজই করছি গত ২২ বছর ধরে, নিরলস। কর্মাধিকৃত সে জীবনে সপ্তাহান্তে আর পাঁচ জন প্রবাসী বাঙালির মতো কলকাতা নিয়ে আহা উহু এবং নিন্দামন্দ করেই থাকি। প্রত্যেক উইকএন্ড পার্টিতেই অনাহুত অতিথির মতো ডোরবেল না বাজিয়ে সেই কলকাতা ঢুকেই পড়ে। ব্যতিক্রম ছাড়াই। শাড়ির ফাঁক দিয়ে সুচতুর গোপন প্রেমিকের মতো সে পায়ে পা ঠেকায় দামি টেবিলের তলা দিয়ে। বিচিত্র বাষ্প জমে আমার চশমার কাঁচে, কানের ফুটোয়, কোথাও এক আনখশির পাপবিদ্ধ অনুরণন। কলকাতাকে ফেলে আসার পাপবোধ।

এইসব রোম্যান্টিক বিলাসিতায় সারা বছর কাটিয়ে প্রতি শীতে উড়ে আসি কলকাতায়। বিমান যখন নামে, এক পাগলাটে ঘোলাটে বাতাসে ফুসফুসটা যেন হাল্কা লাগে। চোখে রং লাগে। বাড়িতে অপেক্ষায় কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুর দম, ট্যাক্সিওয়ালাকে বলি, ‘‘একটু জোরে চালান না দাদা!’’

আমি অত্যন্ত পেটুক এক নারী, ছোট থেকে বাবা শিখিয়েছেন খাওয়ার শিল্প। আমার কাছে কলকাতার সঙ্গে খাবার আর বাংলা নাটক জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত ভাবে। যাকে আমরা রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় বলি ‘কমপ্লিটলি কনফাউন্ডেড’। এ দু’টো বিষয়ে শীতের কলকাতা আজও ভারি মনোরম। তার উপরে আছে শীতের বিয়েবাড়ির ভোজ ও নিমন্ত্রণ, আহারের এত বাহার কেবল বাঙালি বিয়েতেই সম্ভব। এই সংক্ষিপ্ত ছুটিতে কোথা দিয়ে যে একটু একটু করে সামগ্রিক মায়াবিভ্রম তৈরি হয় মনের ভিতরে, তা বোঝা যায় না। নকুড়ের নলেন গুড়ের নরম পাকের জলভরা সন্দেশ, বারিস্তার দুগ্ধফেন দারচিনি দেওয়া বড়দিনের কফি, নান্দীকারের নাট্যমেলায় মঞ্চের সামনে দুমড়েমুচড়ে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে চৌষট্টির অঞ্জন দত্তের রাজকীয় ভিন্সেন্ট ভ্যান গখ বা মধুসূদন মঞ্চে জয় গোস্বামীর কাব্যপাঠ, অনির্বাণের অথৈ নাটকের ইয়াগো, না কি মায়ের হাতের পাটিসাপটা, পায়েস— এদের মধ্যে ঠিক কোনটা মেয়াদশেষে অন্য পৃথিবীতে ফিরে যাওয়াটা দুরূহ করে তোলে, ভাল বুঝতে পারি না।

খাবার আর নাটকের বাইরে আরও অনেক কিছু করতে চাই কলকাতায়। অনেকটা সময় ধার করতে চাই জীবনের কাছে। কলকাতায় অনেক নতুন নতুন গন্তব্যস্থল হয়েছে, যাতায়াতের পথে দেখি। মেয়েকে নিয়ে এক দিন পুরনো ও নতুন শহর দেখাতে বেরোবো। জোড়াসাঁকো থেকে ইকো পার্ক, বাওয়ালির রাজবাড়ি, ইটাচুনা, নিমতিতায় টেনে নিয়ে যাব আমার আঁতেল বন্ধুকে।

অবশেষে লিখি, আমার কাছে কলকাতার সব চেয়ে বড় আকর্ষণ অপ্রত্যাশিত সব বিতর্ক আর আড্ডা। বিদেশের বন্ধুরাও কলকাতায় এসে যেন অন্য রকম হয়ে যান। কেমন একটা পাখা গজায় সকলের, এক প্রগলভ উড়ান ও উত্তরণ। বাড়িতে বিজ্ঞান বনাম শিল্প নিয়ে প্যানেল ডিসকাশন বসে। বাবা, দিদি বনাম আমি ও দাদা। মধ্য রাতের অ্যাক্রোপলিস মলের খোলা রেস্তরাঁয় খোলা বুলেটের মতো অভিযোগ করেন জনৈক বন্ধু— কোয়েন ব্রাদার্সের ছবি দেখছ না, খগম গল্পে ধূর্জটিবাবু পশ্চিমে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন ভুলে গিয়েছ, কাজলাদিদি কবিতাটা কার লেখা বলতে পারছ না, অঙ্কের পেপার লিখছ কিন্তু শিল্প-সাহিত্যে ডাহা ফেল। এই সব বকুনিতে চলন্ত এস্ক্যালেটরে আটকে যায় লম্বা ঝুলের আনারকলি, সে কি তবে পিছুটান? ফুটপাত বদল হয় মধ্য রাতে, বুড়ি চাঁদ মিটিমিটি হাসে। মাথার ভিতরে, মনের ভিতরে কলকাতার নিশিডাক, প্রেতের হাতছানি। পুরোটা কোয়ান্টিফায়েবল নয়। বোধের অগম্য কোন এক বোধ।

আমার শহর নিরন্তর তার দুর্বোধ্য মায়াজাল বুনে চলে। এক জন মৌলিক পরিসংখ্যানবিদের কাছে এই বুঝতে না-পারাটা, ‘মডেল ইনঅ্যাডিকোয়েসি’র লক্ষণ। আমি আমার আমেরিকার কর্মজীবন ও ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালবাসি, চমৎকার আছি। সেই সব ভাল থাকা ও ভালবাসার পিছনে এক মধুর চক্রান্তকারীর মতো কলকাতা ‘মডেল ইনঅ্যাডিকোয়েসি’র বীজ বুনে দিচ্ছে। পৌষের পার্বণ শেষ করে ফিরতে যে হবেই তুষারধবল, কর্মসফল মিশিগানে। পরিযায়ী পাখির মতো আসি-যাই, যৌবনের বারুদ, বিস্ফোরণ ও স্বপ্ন পরে থাকে অনেক দূরে। অকৃত্রিম। কলকাতার কাছে চিরগচ্ছিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nostalgia Kolkata Drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE