এ বার পুজোয় অসুর কে? ঠাকুর দেখতে বেরোনো আম-শহরবাসীর বিচারে তালিকার এক্কেবারে উপরে যদি থাকে বৃষ্টি, তবে তার পরেই আসছে অ্যাপ-ক্যাব। বছর খানেক আগেও যে ক্যাব ছিল কলকাতার প্রাণভোমরা। অ্যাপে বুক করলেই দোরগোড়ায় বাতানুকূল গাড়ি এবং হুশ করে পৌঁছে যাওয়া গন্তব্যে।
সেই ধারণাটাই উল্টে গিয়েছে এ বার। কারণ, পুজোর মরসুমে পকেটভরা টাকা না-থাকলে এ বার অধরাই থেকে গিয়েছে ওলা-উবের। সৌজন্যে ‘সার্জ প্রাইসিং’। অর্থাৎ অ্যাপ-ক্যাবের পরিষেবা পেতে নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বাড়তি হারে ভাড়া। অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রে কয়েক গুণ ভাড়া দিতে চাইলেও জুটছে না গাড়ি। অগত্যা ‘প্রত্যাখ্যান’ আর ‘দাদাগিরি’র জন্য যে ট্যাক্সি থেকে কার্যত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল শহর, সেই ট্যাক্সিই এ বার পুজোয় পরিত্রাতার ভূমিকায়। যাত্রীরা বলছেন, ‘‘ট্যাক্সিচালকেরা ভাড়া হয়তো বেশি চাইছেন। কিন্তু অ্যাপ-ক্যাবের তুলনায় তা ধারেকাছে আসে না।’’
অভিযোগ, মহালয়ার পর থেকে দশমী পর্যন্ত সকাল থেকে মধ্যরাত— ওলা-উবেরের ‘অ্যাপে’ ভাড়ার অঙ্ক সব সময়েই অন্তত দেড়গুণ বেশি। এমনকী তা কখনও উঠে যাচ্ছে চার গুণ ছাপিয়ে। আর বৃষ্টি নামলে তো কথাই নেই। ওলা-উবেরে তখন ভাড়া ৩.৭ গুণ থেকে শুরু। কখনও কখনও তা পেরিয়ে যাচ্ছে পাঁচ গুণও। এবং সেই সঙ্গেই আরও অভিযোগ, সন্ধ্যা নামলে কার্যত আর পাওয়াই যাচ্ছে না গাড়ি। এখানেই শেষ নয়, ওলা-উবের যাতে একই গাড়িতে বেশি যাত্রী নিতে পারে, সে জন্য রাজ্য সরকার নিয়ম শিথিল করেছে। চালু হয়েছে উবের এক্স বা ওলার বড় গাড়ি। অথচ, পুজোর সময়ে পাঁচ জন মিলে ব়ড় গাড়ি বুক করতে চাইলেও তা পাওয়ার সুযোগ জোটেনি। অ্যাপ জানিয়ে দিয়েছে, আপনাকে যেতে হবে দুটো আলাদা গাড়িতে। এবং সে-ও অতিরিক্ত ভাড়ায়।
সব মিলিয়ে অভিযোগ, এ বার পুজোয় অনিয়মের সব সীমাই ছাড়িয়ে গিয়েছে ওলা-উবের। অথচ, মানুষকে যতই দুর্ভোগ পোহাতে হোক, প্রশাসনের তরফে তা কমাতে কোনও উদ্যোগই নেই।
ষষ্ঠীর সন্ধেয় সুজয় গুপ্তের অভিজ্ঞতাই ধরা যাক। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ থেকে নাকতলা যেতে উবেরের গাড়ি বুক করতে চেয়েছিলেন তিনি। বুকিং কনফার্ম করার আগে সম্ভাব্য ভাড়া জানতে চাইতেই চোখ কপালে উঠল! মোবাইল স্ক্রিনে তখন দেখাচ্ছে, ১৭ কিলোমিটার যেতে উবেরের ভাড়া হতে পারে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। ওলা-র হালও কিছুমাত্র আলাদা নয়। শেষমেশ রণে ভঙ্গ দিয়ে তিনশো টাকা দিয়ে ট্যাক্সি চেপেই বাঘা যতীন পৌঁছন সুজয়।
স্বভাবতই পুজোয় সাধারণ মানুষের এই হয়রানির পরে প্রশ্ন উঠেছে, ট্যাক্সির ভাড়া যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা হলে ওলা-উবেরের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন?
ইতিমধ্যেই দিল্লির সরকার ওলা-উবেরকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে, কোনও ‘সার্জ প্রাইস’ নেওয়া যাবে না। সরকারের ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল ওলা-উবের। কিন্তু সেই মামলায় হেরে যাওয়ায় ‘সার্জ প্রাইস’ নিতে পারছে না ওই দু’টি সংস্থা। কিন্তু বাড়তি ভাড়ার দেদার ব্যবসা চলছে কলকাতা-সহ অন্য বড় শহরগুলিতে।
প্রশ্ন উঠছে, দিল্লি পারলে কলকাতা পারে না কেন?
পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বাজারের নিয়ম মেনেই আমরা ঠিক করেছিলাম, ওলা-উবেরের ক্ষেত্রে ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা হবে না। কিন্তু এখন বিভিন্ন মহল থেকে আমরা ওই দুই সংস্থার বিরুদ্ধে যেমন খুশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পাচ্ছি। স্বভাবতই সরকার ওই দুই সংস্থার ক্ষেত্রে ভাড়া নিয়ন্ত্রণের ভাবনা শুরু করেছে।’’
চলতি বছরের শুরুতে ওলা-উবেরের মতো সংস্থাগুলির উপরে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছিল রাজ্য সরকার। কথা ছিল, শর্ত পূরণ করলে তবেই সংস্থাগুলিকে লাইসেন্স দেওয়া হবে। প্রাথমিক ভাবে সরকারের আরোপ করা শর্ত মানতে কিছু সময় লাগবে বলে জানিয়েছিল সংস্থাগুলি। সেইমতো গত ১৫ জুন পর্যন্ত তাদের সময় দেয় সরকার। কিন্তু তার পরেও সংস্থাগুলির তরফে ফের সময়সীমা বাড়ানোর আর্জি জানানো হয়। বিশেষত, সিসি ক্যামেরা বসানোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে জানায় সংস্থাগুলি। এর পরেই সংস্থাগুলিকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সময়সীমার মধ্যে সব শর্ত মানা হলেই
তবেই দু’বছরের জন্য স্থায়ী লাইসেন্স দেওয়ার কথা সংস্থাগুলিকে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওলা ফের আবেদন জানালে তাদের অস্থায়ী লাইসেন্সের সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ওলা এখনও পর্যন্ত লাইসেন্সের আবেদনই জানায়নি। সরকারের নির্দেশিকাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। তবে এই অবস্থায় চটজলদি কোনও সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভাড়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতিই নিতে চাইছে সরকার।
যদিও ওলা-উবেরের তরফে ব্যাখ্যা, বাজারের চাহিদা ও জোগানের সাধারণ নীতি মেনেই ভাড়া ওঠানামা করে। এটি সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে না। উবেরের এক কর্তার কথায়, ‘‘অনেক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে চালকেরা গাড়ি বার করতে চান না। কিন্তু ‘সার্জ’ থাকলে ওঁরা গাড়ি বার করেন।’’ তবে প্রয়োজনে বড় গাড়ি না মেলার প্রসঙ্গে সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার অশ্বিন ডায়াসের বক্তব্য, ‘‘যে সব শহরে বড় গাড়ির চাহিদা বেশি, সেখানে আমরা উবের এক্সএল গাড়ি পথে নামিয়েছি। আমাদের সমীক্ষা বলছে, কলকাতায় উবের গো এবং উবের এক্স-ই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাই এ শহরে এখনও উবের এক্সএল চালু করা হয়নি।’’
ওলা-উবের নিয়ে মানুষের ক্ষোভের সুযোগ অবশ্য নিচ্ছেন ট্যাক্সিমালিক এবং চালকদের একাংশ। এক ট্যাক্সিমালিকের কথায়, ‘‘আমরা বেশি ভাড়া চাইতাম, প্রত্যাখ্যান করতাম বলে যাত্রীদের অসন্তোষ সঙ্গত। কিন্তু এই সব সংস্থা তো দিনে-দুপুরে ডাকাতি করছে। দেখবেন, কয়েক মাস পরে রাস্তায় শুধু ট্যাক্সিই থাকবে। বাকি সব উবে যাবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy