বিকিকিনি: চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরে বসেছে মধ্যরাতের পসরা। ছবি: সুমন বল্লভ
কাঁখে-মাথায় পোঁটলা নিয়ে বছর পঁয়ষট্টির কমলা তখন টাকি স্টেশনের ডাউন লাইনে। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। গন্তব্য কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের গিরিশ পার্কে পুরনো কাপড়ের হাট। সপ্তাহের এই একটা দিন তাঁর সঙ্গী হন ছোট দুই বোন ও ছোটজনের বছর দশেকের ছেলে। ছেলেটির হাতে ধরা চার জনের রাতের খাবার, দু’টাকা কিলো চালের ভাত এবং কমলার সাধের বাগানের পুঁই আর কুমড়োর তরকারি। পিছনে পড়ে থাকে ইছামতী, মাটির ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর বিধবা কমলার খোঁজ না নেওয়া তিন সন্তানের পরিবার।
‘‘বছর সাত-আট ধরে এ ভাবেই চলছে। ছোটর বাড়ি মালদায়। স্বামী ভাত দেয় না বলে ছেলে নিয়ে আমার সঙ্গেই থাকে,’’ চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের প্রশস্ত রাস্তার এক ধারে আধশোয়া অবস্থায় বললেন কমলা। গিরিশ পার্ক এলাকার লিবার্টি সিনেমা হলের সামনে আর তার দু’ধার ছাড়িয়ে রাস্তার দখল তত ক্ষণে নিয়ে ফেলেছেন দূর-দুরান্ত থেকে আসা মানুষ।
ঘড়িতে রাত দেড়টা। রাস্তার উপরেই থরে থরে পোঁটলা নিয়ে উপুড় বা চিৎ হয়ে, কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছেন ফেরিওয়ালারা। ঘণ্টাখানেক পরে ওই পোঁটলা থেকেই বেরিয়ে আসবে রংবেরঙের পুরনো কাপড়ের সম্ভার। প্রতিদিন কয়েক হাজার ফেরিওয়ালা আর খদ্দেরের এই মেলায় কত টাকার লেনদেন হয়? স্পষ্ট উত্তর মেলে না। হাটের বয়স ঠিক কত, তা-ও জানা নেই কারও। রাত দুটো থেকে শুরু হয়ে সকাল আটটায় শেষ হয়ে যায় সব। কাটোয়া, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, আসানসোল আর এ রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা গুজরাতের বাসিন্দারা তখন ঘরের পথে।
পঞ্চাশ বছর ধরে রিষড়া থেকে এ হাটে আসেন বছর ছিয়াত্তরের আব্দুল হামিদ। অদ্বৈত মল্লিক লেনের মুখে কাপড় পেতে বসা আব্দুল চাচাকে তাসের ঠেক থেকে টেনে তুলতে বেগ পেতে হল। গিয়ারে চাপ পড়তেই ভেসে উঠল ষাটের দশকের মাঝামাঝি এই হাটের চেহারাটা। ঘোলাটে চোখ আর ক্ষয়াটে চেহারার বৃদ্ধ বলে চলেন, ‘‘তখন শুধু কয়েক জন ফেরিওয়ালা ছিল। বড় রাস্তায় এক জনও বসত না। অদ্বৈত লেনের শেষ প্রান্তে উকিলসাবের বাড়ির সামনে আমরা বসতাম। দাম হত এক আনা থেকে চার আনার মধ্যে। চাচা বকরিদির সঙ্গে প্রথম যখন হাটে আসি, তিনি তখন ধর্মতলার মেট্রো সিনেমা হলের সামনে বসে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে বিক্রি করতেন।’’
পুরনো কাপড়ের মধ্যেও এখানে রকমফের রয়েছে। কেউ শুধু ছেঁড়া কাপড় বেচেন, কেউ পুরনো শাড়ি-লুঙ্গি, অথবা সালোয়ার। কেউ বা হাল ফ্যাশনের জামা, ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট তো কেউ আবার মশারি-চাদর। সব থেকে কম এক টাকা, সব থেকে বেশি সত্তর টাকার জিনিস মিলবে এখানে।― পাশ থেকে বলে উঠলেন আশ মহম্মদ। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে চুঁচুড়া থেকে আসছেন মন্টু মহুলি। লাভ আছে এই কারবারে? উত্তর এল, না থাকলে এত কষ্ট কেউ করে! তাঁর আরও সংযোজন, “সংসার টানছি তো এই রোজগারেই।”
হাটেই দেখা হল নিয়মিত ক্রেতা আফতাব আলমের সঙ্গে। শুধু শাড়িই কেনেন তিনি। প্রথমেই ফলস খুলে নেওয়া হয়। তার পর ছেঁড়া শাড়ি গ্রামেই রিপু করতে দেন। এর পরেই তা পালিশ করে নতুন হয়ে আসে ধানবাদ থাকে। ধানবাদ কেন? আফতাব জানালেন, ওখানে এই কাজ সব থেকে ভাল ভাবে আর সস্তায় হয়। এর পরে তা আফতাবের হাত হয়ে পৌঁছে যায় মেটিয়াবুরুজ বা গার্ডেনরিচের আস্তানায়। তবে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলা তাঁর শখের শাড়িটি যখন দু’দিন পরেই আলমারি থেকে ফেরিওয়ালার ঝোলায় নির্বাসন দেন, তখন সব থেকে বেশি লাভবান হন এই আফতাবেরা। এ সব শাড়ি বেচে পকেটে দশগুণ কড়কড়ে টাকা ঢোকে।
কচি বাচ্চা, বৌ আর বোনকে শুইয়ে গাঁটরিতে হেলান দিয়ে মোবাইলে সিনেমা দেখছিলেন জিগ্নেশ। গল্প করতে করতে জানালেন, সারা দিন কাপড়ের বিনিময়ে বাসন আর প্লাস্টিকের জিনিস ফেরি করেন ওঁরা। কাপড় বাছাইয়ের কাজ জিগ্নেশই করেন। তবে ওঁদের সঙ্গে রাখলে সব দিকে চিন্তা কম হয় বলে জানালেন বছর একুশের ওই যুবক।
রাস্তায় শুতে ভয় লাগে না? সমস্বরে জবাব, আজ পর্যন্ত তো কিছু হয়নি। পাশ থেকে এক জন স্মৃতি হাতড়ে শোনালেন বছর কুড়ি আগের এক দুঃসহ সকালের কথা। হাট প্রায় শেষ। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি চলছিল, এমন সময়ে বেপরোয়া গতির বাস পিষে দিয়েছিল এক ফেরিওয়ালার সন্তানকে। রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ।
কয়েক হাজার পরিবারের লক্ষ্মী এ পথেই। ওঁদের কথায়, স্থানীয় কোনও উপদ্রব বা পুলিশের চোখরাঙানি নেই এই হাটে। ওঁরা শুধু ডরান বৃষ্টিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy