ভোট চলাকালীন বিটি রোড চত্বরে মুখ ঢাকা বহিরাগতরা। সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
কলকাতা পুরভোটে বেশ কয়েকটি এলাকায় বহিরাগতরা যে দাপিয়ে বেড়াবে, তার ইঙ্গিত মিলছিল গত কয়েক দিন ধরেই। শাসক দলের তরফে এমন সম্ভাবনাকে ‘গালগল্প’ বলে উড়িয়ে দিলেও বিরোধীদের আশঙ্কা ছিল, বহু জায়গায় ভোট নিয়ন্ত্রণ করবে এই বহিরাগতরাই। ভোটের দিন দেখা গেল, বিরোধীদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হল।
এ দিন সকালে ভোটপর্ব শুরুর ঘণ্টাখানেক পর থেকেই যাদবপুরের শহিদ স্মৃতি এলাকায় একটা ভিড় দানা বাঁধছিল। পুলিশের আনাগোনা থাকলেও উত্তেজনার পারদ যে বাড়ছে, তার আঁচ মিলেছিল শনিবার সকাল থেকে। এমনিতেই কলকাতা পুরসভার ১০৯ নম্বর ওয়ার্ড গত দু’দিন ধরে সরগরম। তৃণমূল ও সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারির জেরে তাই ওই এলাকায় কলকাতা পুলিশের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বাহিনীও মোতায়েন করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেই কেন্দ্রীয় বাহিনীরই এক জওয়ান সকাল ১০টা নাগাদ শহিদ স্মৃতি বুথের বাইরে আচমকাই জাপটে ধরলেন একজনকে! পরে পুলিশ জানায়, তাঁর নাম জুলফিকার মোল্লা। তিনি তৃণমূলের জয়হিন্দ বাহিনীর ভাঙড় ২ নম্বর সভাপতি! বেশ কয়েক বার বুথে ঢুকতে এবং বেরোতে দেখে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওই জওয়ান তাঁর কাছে সচিত্র পরিচয়পত্র দেখতে চান। তা দেখাতে না পারায় জুলফিকারকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন ওই জওয়ান। পরে জানা গিয়েছে, ভোটপর্ব মেটার পরে ওই তৃণমূল নেতাকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে!
ভোটের দিন বহিরাগতেরা যে কলকাতায় ঢুকবে, সে খবর অবশ্য পুলিশের কাছে ছিলই। তা সত্ত্বেও প্রশাসন আগাম কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ বিরোধীদের। সেই বহিরাগতেরাই যে বেশ কিছু ওয়ার্ডে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা পালন করেছে, তার কিছু নমুনা মিলেছে শহরের নানা প্রান্তে। যেমন বড়বাজার এলাকায় যত বেলা গড়িয়েছে, ততই চোখে পড়েছে নতুন নতুন মুখ। সেই মুখগুলোকে কেন্দ্র করেই উত্তেজনা ছড়ায় ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কলাকার স্ট্রিটে। সেখানকার বিজেপি এবং তৃণমূল প্রার্থী মিনাদেবী পুরোহিত এবং দীনেশ বাজাজ একে অন্যের বিরুদ্ধে বাইরের লোক ঢোকানোর অভিযোগ এনেছেন। স্থানীয় মহেশ্বরী স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে মীনাদেবী বলেন, ‘‘হাওড়া থেকে লোক এনে এলাকা অশান্ত করার চেষ্টা করছেন তৃণমূল প্রার্থী। এমনকী, রাজ্যের মন্ত্রী তথা হাওড়ার বিধায়ক অরূপ রায়ও এসেছেন।’’ মীনাদেবীর অভিযোগ উড়িয়ে দীনেশবাবুর বক্তব্য, ‘‘অরূপ আমার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। চা খেয়ে চলে গিয়েছে। বুথের ধারেকাছেও যায়নি।’’ কিন্তু কেন তিনি ভোটের দিনে চা খেতে বড়বাজারে গিয়েছিলেন? মন্ত্রীর উত্তর, ‘‘বড়বাজারে এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে দীনেশের সঙ্গে দেখা হলে ও চা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করে। তাই চা খেয়েই হাওড়ায় ঢুকে পড়ি।’’
বহিরাগত ঢোকানোর অভিযোগ উঠেছে ১২ নম্বর বরোর ১০১, ১০৮, ১০৯ এবং ১১০ নম্বর ওয়ার্ডেও। বিরোধীদের অভিযোগ, কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, বামনঘাটা ও কাশীপুর এলাকার একাধিক তৃণমূল নেতাকে যাদবপুরের বিভিন্ন বুথের ধারেকাছে দেখা গিয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, দিন তিনেক আগে থেকেই কলকাতা পুর-এলাকায় ডেরা বেঁধেছিলেন শহরতলির তৃণমূলের নেতা-কর্মী-ভোট ম্যানেজারেরা। তাঁরাই এ দিন ‘সন্ত্রাস’ করেছে বলে বিরোধীদেরঅভিযোগ। পুলিশেরই খবর, যেমন ১১০ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু বুথে ভোট করানোর দায়িত্বে ছিলেন ভাঙড়-২ ব্লকের এক তৃণমূল নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা করেছি।’’ ওই নেতা জানান, ভাঙড়, বামনঘাটা ও কাশীপুর থেকে ছ’শোর মতো কর্মী-সমর্থক এ দিন কলকাতা পুরভোটে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা আশাবাদী, যাদবপুরের ফল আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল হবে!
পুলিশ সূত্রের খবর, শুধু যাদবপুর নয়, বেহালা, ঠাকুরপুকুর, জোকা এবং বন্দর এলাকাতেও দাপিয়ে বেড়িয়েছে ক্যানিং-জয়নগরের তৃণমূল নেতারা। ক্যানিংয়ের এক নেতা বলেন, ‘‘ভোটের দিন বুথের লাইনে একটু ঠেলাঠেলির দায়িত্ব ছিল আমাদের উপরে! বেপাড়ার লোক হিসেবে যতটা করা যায়, করেছি।’’ তবে বন্দর এলাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি জয়নগর এলাকার তৃণমূল নেতারা। ভোটের পর ওদের আক্ষেপ, ‘‘নজরদারি বেশিই ছিল ওখানে। তাই নেতাদের সঙ্গে থেকে দল ভারী করা আর কিছুই করতে পারিনি!’’
সকাল থেকে বহিরাগতদেরই ভিড় দেখেছে দক্ষিণ শহরতলির নেতাজিনগরের কেয়াবাগান। দুপুর আড়াইটে নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখা যায়, উত্তেজিত গলায় আলোচনা করছেন এক দল লোক। এক প্রৌঢ় বললেন, ‘‘এখানে ৪০ বছরের বাস। কখনও ভোটের দিন এত বাইরের মুখ দেখিনি!’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘‘ভোট নিশ্চিন্তেই হচ্ছিল। আচমকাই দুপুর ২টোর একটু আগে জনা কুড়ির দল চার-চারটে গুলি ছুড়ে চলে গেল! ওঁরা কারা? আমাদের পাড়ায় থাকে না, আশপাশেও থাকে না!’’ ওই বাসিন্দাদের আক্ষেপ, হয়তো কেয়াবাগানেও ভোটের দিন গুলি চালানোর সংস্কৃতিটা চালু হয়ে গেল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy