Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Pollution

দূষণে দিল্লিকে টপকাল কলকাতা! মানতে নারাজ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পর্ষদ

মার্কিন কনস্যুলেটের তরফে বুধবার জানানো হয়, তাদের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে, একমাত্র পার্ক স্ট্রিট এলাকার বায়ুর গুণগত মান নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়।

কলকাতায় ভোরের ময়দান। ছবি: সংগৃহীত।

কলকাতায় ভোরের ময়দান। ছবি: সংগৃহীত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:৫৫
Share: Save:

বায়ুদূষণে দিল্লিকে পিছনে ফেলে কলকাতার ‘এগিয়ে যাওয়া’র তত্ত্ব মানতে নারাজ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদও রাজ্যের যুক্তিকে মেনে নিয়েছে।

কিন্তু কেন এই বিতর্ক?

কলকাতা, দিল্লি সমেত বেশ কয়েকটি শহরে মার্কিন কনস্যুলেট নিজস্ব পরিকাঠামোয় অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) মাত্রা নিয়মিত ভাবে পরিমাপ করে। উদ্দেশ্য, কনস্যুলেটের কর্মীরা কোন পরিবেশে কাজ করছেন তা জানা এবং জানানো। সেই তথ্য কনস্যুলেটের ওয়েবসাইটে প্রতি ঘণ্টায় আপডেটও করা হয়। ওয়েবসাইটের সেই তথ্য অনুযায়ী, গত রবি, সোম এবং মঙ্গলবার কলকাতা শহরে বায়ুদূষণের পরিমাণ দিল্লির তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। দিল্লির দূষণ বেশ কয়েক বছর ধরেই গোটা দুনিয়ায় আলোচিত বিষয়। কিন্তু কলকাতা যে তাকেও টপকে গিয়েছে এমন তথ্য সামনে আসায় কলকাতাবাসী চমকে যান।

মার্কিন কনস্যুলেট অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) মাত্রা যে পদ্ধতিতে পরিমাপ করে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। তিনি বলেন, ‘‘শহরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বায়ুদূষণের তথ্যের ভিত্তিতে গোটা কলকাতার বাতাসের গুণগত মান নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না।’’

মঙ্গলবার দুপুর তিনটেয় যা ছিল ২৮৩, বুধবার একই সময়ে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট চত্বরে সেই
দূষণমাত্রা ছিল ১৭৮। আবার দিল্লিতে গত কাল যা ছিল ২২৭, এ দিন সেটাই একই সময়ে ছিল ৪১৮।

কল্যাণবাবুর দাবি, হো চি মিন সরণিতে মার্কিন কনস্যুলেটে বায়ুদূষণের যে মনিটরিং সেন্টারটি রয়েছে তা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম মেনে করা হয়নি। প্রথমত, শহরের কোনও বড় রাস্তার ধারে এমন সেন্টার তৈরি করা যায় না। দ্বিতীয়ত, সেন্টারের আশেপাশে বড় কোনও ঘরবাড়ি থাকা উচিত নয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, একটা শহরে একাধিক সেন্টার তৈরি করে সেগুলি থেকে পাওয়া তথ্যের গড় করেই কোনও শহরের বায়ুদূষণের পরিমাণ জানাতে হয়। কল্যাণবাবুর কথায়, ‘‘এ ক্ষেত্রে মার্কিন কনস্যুলেট মাত্র একটি সেন্টারের তথ্যের ভিত্তিতেই দূষণের পরিমাপ জানাচ্ছে। আগে নিয়মটা তো মানতে হবে।’’

আরও খবর
দূষণ-তথ্য লুকোচ্ছে রাজ্য, নালিশ আদালতে

যদিও মার্কিন কনস্যুলেটের তরফে বুধবার জানানো হয়, তাদের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে, একমাত্র পার্ক স্ট্রিট এলাকার বায়ুর গুণগত মান নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। হো চি মিন সরণির কনস্যুলেটে বসানো দূষণমাপক যন্ত্রের মাধ্যমে যে তথ্য পাওয়া যায় সেটাই মার্কিন সরকারের ইপিএ (এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি)-র এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সেখানে এ-ও বলা আছে, একটি মনিটরিং স্টেশন দিয়ে গোটা শহরের দূষণের মাপ করা যায় না। তাই বায়ুর গুণগত মানের যে তথ্য মার্কিন কনস্যুলেটের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়, কলকাতার অন্য কোনও জায়গার সঙ্গে তা না-ও মিলতে পারে। আর সে জন্যই তাদের তথ্যের সঙ্গে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটের লিঙ্ক দেওয়া হয়। কারণ, শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের মনিটরিং সেন্টার রয়েছে। মার্কিন কনস্যুলেটের দাবি, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে ভাবে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার মাত্রা পরিমাপ করে তার সঙ্গে তাদের পদ্ধতির কোনও মিল নেই।

আরও খবর
বিপদ এড়াতে ধোঁয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে নাক

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অতিরিক্ত অধিকর্তা তথা বায়ুদূষণ গবেষণাগারের প্রধান দীপঙ্কর সাহাও কল্যাণবাবুর সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘‘এ ভাবে শহরের একটি বিশেষ জায়গার মাপের ভিত্তিতে গোটা শহরের দূষণ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।’’ তাঁর মতে, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় পর্ষদের একটা সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা আছে। শহরের যে জায়গায় দূষণ বেশি, তার পাশাপাশি সবুজ অংশেও মনিটরিং সেন্টার করা উচিত। কারণ, দূষণ ব্যাপারটা স্থিতিশীল নয়, পরিবর্তনশীল। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমরা যে ১২টি মাপকাঠি মেনে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার মাত্রা মাপি, মার্কিন কনস্যুলেট তার বেশির ভাগই মেনে চলে না।’’ তাঁর মতে, ভূমি ব্যবহার রীতি এক এক দেশে এক এক রকমের। ওই ব্যবহারের উপর দূষণের মাত্রা অনেকটাই নির্ভর করে। তাই মার্কিন মানদণ্ড দিয়ে এ দেশের দূষণের মান নির্ধারণ করা উচিত নয়।

দিনের ব্যস্ত সময়ে ধর্মতলা মোড়। ছবি: সংগৃহীত।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের প্রাক্তন মুখ্য আইন আধিকারিক তথা পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ও মেনে নিচ্ছেন পর্ষদের এই তত্ত্ব। পাশাপাশি তাঁর দাবি, শহরে প্রতি দিন বিভিন্ন দূষণের মাত্রা বাড়ছে। তার মধ্যে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছে সব থেকে বেশি হারে। তাঁর কথায়, ‘‘বায়ুদূষণ বাড়ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু মার্কিন কনস্যুলেটের তথ্যের বিরোধিতা করতে গেলে রাজ্যের নিজস্ব তথ্য থাকতে হবে। সেই তথ্য দিয়েই তো অন্যের দাবি খণ্ডানো যেত। রাজ্যের হাতে নিশ্চয়ই সেই তথ্য নেই!’’

তবে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কলকাতার পরিমণ্ডলের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। বিশেষত, শীতের এই সময়টায়। কারণ, মাথার ঠিক উপরে কুয়াশার আস্তরণ হিসেবে যা বিছিয়ে রয়েছে তাতে রয়েছে হাজারো ‘বিষ’। গাড়ির ধোঁয়া থেকে বেরোনো কার্বন কণা, বেঞ্জিন যৌগ, সিসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জন্য বাতাসে মিশে থাকা বালি, ইট, পাথর, অ্যাসবেস্টসের গুঁড়ো। এগুলি (কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, বেঞ্জিন যৌগ, সিসা) ফুসফুসে বা শ্বাসনালীর কোষে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এদের কারও কারও বিষক্রিয়ায় ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে বলে জানাচ্ছেন শারীরবিজ্ঞানীরা। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দূষণের সূচক ১০০-র উপরে থাকলেই তাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর সেই মাত্রা যদি ২০০ ছাড়ায়, তা হলে সেই অবস্থা ‘ভীষণ অস্বাস্থ্যকর’। যদিও এ দেশে সূচক ২০০-র নীচে থাকলে তাকে ধরা হয় ‘অস্বাস্থ্যকর নয়’।

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তত্ত্বাবধানে রাজ্য পর্ষদ শহরের মোট ১৯টি জায়গায় দূষণ মেপে দেখার জন্য মনিটরিং সেন্টার চালায়। তার মধ্যে দু’টি স্বয়ংক্রিয় এবং বাকি ১৭টি অস্বয়ংক্রিয়। দু’টি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের একটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে এবং অন্যটি বিটি রোডের উপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রয়েছে। কিন্তু, আপাতত বহু পুরনো ওই দু’টি মনিটরিং সেন্টারই প্রযুক্তিগত উন্নতিকরণের জন্য বন্ধ রয়েছে। বাকি ১৭টি সেন্টারে সপ্তাহে দু’বার করে দূষণের মাত্রা মেপে দেখা হয়। মাপার ৪৮ ঘণ্টা পর সেই তথ্য পর্যদের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয় বলে পর্ষদের দাবি।

তা হলে প্রতি দিন ঘণ্টা মেপে দূষণ মাপার কোনও ব্যবস্থা রাজ্যের হাতে নেই? কল্যাণবাবুর দাবি, জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি)-র সঙ্গে মিশে উপায় বার করার চেষ্টা চলছে। কেন্দ্রীয় পর্ষদের নিয়ম মেনেই অস্বয়ংক্রিয় সেন্টারগুলিতে দু’দিন মাপা হয়। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আপাতত বন্ধ বলে পর্যদ সেই দু’দিনটা আরও বাড়ানো যায় কি না বিবেচনা করে দেখছে।

কিন্তু, দু’টি সেন্টারই একসঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হল কেন? পর্যদের যুক্তি, কেন্দ্রীয় পর্ষদ অনেক দিন ধরেই উন্নতিকরণের কথা বলেছিল। কিন্তু, যুব বিশ্বকাপ এই শহরে হচ্ছিল বলে তা করা যায়নি। এক কর্তার কথায়, ‘‘ফিফার বড্ড কড়াকড়ি ছিল। ওই টুর্নামেন্ট শেষ হতেই কাজ শুরু করা হয়েছে।’’

আরও খবর
মুখোশের ক্রিকেট, কটাক্ষ মমতার

কলকাতায় যেখানে ১৯টি, দিল্লি এবং সংলগ্ন এলাকাতে সেখানে প্রায় ৪৮টি সেন্টার রয়েছে। যার মধ্যে ৩৮টিই স্বয়ংক্রিয়। এবং প্রতি মুহূর্তে সেই তথ্য সেই সব জায়গায় ডিসপ্লে বোর্ডে দেখা যায়। দেখা যায় কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটেও। দিল্লিতেও মার্কিন কনস্যুলেট আলাদা করে দূষণ মাপার কাজ করে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি অসরকারি সংগঠনও একই কাজ করে। এবং গোটা শহর জুড়েই এই সেন্টারগুলি চালানো হয়।

স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ঘণ্টা প্রতি দূষণ মাপাটা কি সেই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নয়?

দীপঙ্করবাবুর দাবি, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যাখ্যা, ধরা যাক, কোনও একটি জায়গায় হঠাৎ করে কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে গেল। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এ মাপ জানার পরেই সেই রাস্তায় গাড়িঘোড়া অন্য পথে ঘুরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আবার কোনও রাস্তায় হঠাৎ করে ধূলিকণার মাত্রা বেড়ে গেলে জল দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ওই ঘণ্টা প্রতি পরিমাপ কাজে আসে। আর স্বয়ংক্রিয় নয় এমন পদ্ধতির মাপ আসলে কোনও শহরে দূষণের গতিপ্রকৃতি এবং সেই দূষণ নাগরিকদের স্বাস্থ্যের উপর কী প্রভাব ফেলছে, তা খতিয়ে দেখতে কাজে লাগে।

তা হলে কলকাতায় স্বয়ংক্রিয় মনিটরিং সেন্টার এত কম কেন? দীপঙ্করবাবু জানিয়েছেন, কলকাতায় দু’টি বহু পুরনো স্বয়ক্রিয় মনিটরিং সেন্টার রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় পর্ষদের তত্ত্বাবধানে আরও দু’টি স্বয়ংক্রিয় সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। একটি যাদবপুরে, অন্যটি বেলুড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE