খবরের কাগজে সংস্থাটির কথা পড়েছেন। টিভিতেও ওই সংস্থার কাজকর্ম সম্পর্কে পুলিশকর্তাদের ঢালাও সার্টিফিকেট দিতে শুনেছেন। কিন্তু কী ভাবে ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়, তা জানেন না লেক গার্ডেন্সের মালা মজুমদার।
নিজের ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। স্বামী মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। ছেলে থাকেন কলকাতার বাইরে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা বিপদে পড়লে কে দেখবে, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না বৃদ্ধার।
‘প্রণাম’-এর সদস্য হলেন না কেন? মালাদেবী বলেন, ‘‘কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ বলে একটা সংস্থা আছে শুনেছি। কিন্তু পুলিশের তরফে কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। কী ভাবে সদস্য হওয়া যায়, তা-ও কখনও কেউ বলেনি।’’
বেনিয়াপুকুরের ৭৫ বছরের রঞ্জিত ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। বিপত্নীক রঞ্জিতবাবুর একমাত্র ছেলে থাকেন আমেরিকায়। রঞ্জিতবাবুও প্রণামের সদস্য নন।
কেন? রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘আমি ভেবেছিলাম আমাদের মতো নিঃসঙ্গ লোকেদের সাহায্যের জন্যই ‘প্রণাম’। অনেক আশা নিয়ে সদস্য হতে আবেদন করি। কিন্তু থানা থেকে বলা হয়, ‘আর সদস্য নেওয়া হচ্ছে না’। এর পরে আর যোগাযোগ করিনি। থানাও যোগাযোগ করেনি। আমার আর প্রণামের সদস্য হওয়া হয়নি।’’
আর এই প্রকল্প নিয়ে যথাযথ প্রচারের অভাব, পুলিশের একাংশের তরফে দায়সারা ভাব— সব মিলিয়ে সাত বছরেও কিন্তু সাবালক হতে পারল না ‘প্রণাম’। শহরের অধিকাংশ নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে যুক্ত করা গেল না এই প্রকল্পের সঙ্গে। অথচ গত দু’বছরে নিজেদের ফ্ল্যাটেই খুন হতে হল ন’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে। পাইকপাড়ার বৃদ্ধ দম্পতি সর্বশেষ উদাহরণ। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, ‘‘লালবাজার থেকে এই প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট ভাবে এক জনকে দেওয়া হলেও কোন এলাকায় কত জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এই প্রকল্পে সামিল হলেন, তা দেখার কেউ নেই। কোনও টার্গেটও বেঁধে দেওয়া হয়নি। তাই নিজের মতো করে করে চলছে অভিভাবকহীন এই প্রকল্প।
‘প্রণাম’ তৈরির মূল উদ্দেশ্য কী? লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘যে কোনও শহরেই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা দুষ্কৃতীদের সহজ টার্গেট। শারীরিক কারণেই তাঁরা দুষ্কৃতীদের বাধা দিতে পারেন না। তাই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে থেকে তাঁদের নিরাপত্তা এবং সাহস জোগাতেই তৈরি হয়েছিল প্রণাম।’’ লালবাজারের দাবি, ওই প্রকল্পের জন্য কলকাতার প্রতিটি থানাতেই এক জন অফিসারের নেতৃত্বে চার জন করে পুলিশকর্মীকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও জুন মাস পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের ওই ৬৯টি থানা এলাকায় ‘প্রণাম’-এর সদস্য-সংখ্যা কেন ১২ হাজারে ঠেকে থাকল, উঠেছে সেই প্রশ্ন।
প্রতি মাসে প্রতিটি ডিভিশনে সদস্যদের নিয়ে প্রণামের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। তাতে যে কাজের কাছ কিছু হচ্ছে না, তা কিন্তু মানছেন ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থানা পর্যায়ের অফিসারেরা। এক অফিসারের মন্তব্য, “বর্তমানে থানাগুলির যা পরিকাঠামো, তাতে আলাদা করে একা থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য কোনও রকম বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। আমরা জানি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্য সংগ্রহ করা হলে প্রকল্পটি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু আমাদের কাছে এমন নির্দেশও নেই।’’
লালবাজারের কর্তারা বলছেন, “কোনও বাড়িতে নতুন পরিচারিকা-পরিচারক নিয়োগ করার আগে তাদের সবিস্তার তথ্য থানায় জমা দেওয়ার নিয়ম আছে। তেমনই কোনও বাড়িতে একলা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকলে আমরা সব সময়ে তাঁদের প্রণামের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন জানিয়ে থাকি। আমাদের সদস্য হলে মাঝে মাঝেই তাঁর খোঁজ খবরও নেওয়া হয়। সদস্যদের কাছে প্রণামের এক জনের নম্বর দেওয়া থাকে। প্রয়োজনে ফোন করে তিনি সাহায্য চাইতেই পারেন।’’
কিন্তু রঞ্জিত ভট্টাচার্য, মালা মজুমদারদের প্রশ্ন, নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা থানায় যাবেনই বা কী করে? পুলিশের সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলায়নি। রঞ্জিতবাবুদের সুপারিশ, এই প্রকল্প সফল করতে হলে পুলিশকেই খুঁজে বার করতে হবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। সদস্য করাতে হবে প্রণামের।
প্রণাম প্রকল্পের পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সম্প্রতি কলকাতা পুলিশ কমিশনার ওই প্রকল্পের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে জোর দিতে বলেন। তাতে কাজ হয়নি। অতিরিক্ত কমিশনার (২) জয়ন্ত বসু বলেন, ‘‘সদস্য বৃদ্ধি করার পাশাপাশি পরিকাঠামো বাড়ানোর জন্যও চেষ্টা করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy