Advertisement
০১ মে ২০২৪
প্রশ্ন মনোবিদদের

বিভ্রম-বশেই কি লাশ আগলে দিনযাপন

দিন সাতেক আগে এক বার হঠাৎ বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে বুকফাটা যন্ত্রণায় চিল-চিৎকার করে উঠেছিলেন পার্থ দে। মধ্য চল্লিশের লোকটিকে সে দিন সিকিওরিটি গার্ডরা কোনও মতে শান্ত করে ঘরে ঢুকিয়ে দেন। বলতে গেলে সেই প্রথম। আপাতদৃষ্টিতে মুখচোরা, অন্তর্মুখী পার্থের আচরণে এর আগে বিশেষ অস্বাভাবিকতা আশপাশের মানুষ টের পাননি। রবিনসন স্ট্রিটের দে পরিবারের অন্দরের কাণ্ড-কারখানা প্রকাশ্যে আসার পরে মনোরোগ-বিশেষজ্ঞদের অনেকের দাবি, পার্থের ভিতরে অনেক দিন ধরেই টানাপড়েন চলছিল। এবং সে দিনের আর্তনাদ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ। ‘‘সন্দেহ নেই, উনি ভ্রান্ত ধারণা বা ভ্রম আঁকড়ে বসবাস করছিলেন।’’

বাড়ি থেকে বার করে আনা হচ্ছে কঙ্কাল। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

বাড়ি থেকে বার করে আনা হচ্ছে কঙ্কাল। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

দিন সাতেক আগে এক বার হঠাৎ বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে বুকফাটা যন্ত্রণায় চিল-চিৎকার করে উঠেছিলেন পার্থ দে। মধ্য চল্লিশের লোকটিকে সে দিন সিকিওরিটি গার্ডরা কোনও মতে শান্ত করে ঘরে ঢুকিয়ে দেন।

বলতে গেলে সেই প্রথম। আপাতদৃষ্টিতে মুখচোরা, অন্তর্মুখী পার্থের আচরণে এর আগে বিশেষ অস্বাভাবিকতা আশপাশের মানুষ টের পাননি। রবিনসন স্ট্রিটের দে পরিবারের অন্দরের কাণ্ড-কারখানা প্রকাশ্যে আসার পরে মনোরোগ-বিশেষজ্ঞদের অনেকের দাবি, পার্থের ভিতরে অনেক দিন ধরেই টানাপড়েন চলছিল। এবং সে দিনের আর্তনাদ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ। ‘‘সন্দেহ নেই, উনি ভ্রান্ত ধারণা বা ভ্রম আঁকড়ে বসবাস করছিলেন।’’— বলছেন মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম। আর এক বিশেষজ্ঞ প্রদীপ সাহার ব্যাখ্যা, ‘‘এই জাতীয় সঙ্কটে কখনও কখনও বাস্তবের অভিঘাত তীব্র যন্ত্রণা দেয়। বিভ্রম থেকে সাময়িক ভাবে বেরিয়ে আসার তাগিদেই সম্ভবত পার্থ সে দিন চিৎকার করে উঠেছিলেন।’’

মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, এই ধরনের বিভ্রম হল ‘শেয়ার্ড ডিল্যুশন’ বা ‘ডিল্যুশন্যাল ডিসর্ডার।’ হয়তো সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, অলীক, বাস্তবচ্যূত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে এতটাই বিশ্বাসী যে, কেউ ধারণাটি ভেঙে দিতে চাইলে বা বিরোধিতা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, মানতে চান না। মধ্য কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের অভিজাত পাড়ার দীর্ঘ দিনের সম্ভ্রান্ত বাসিন্দা দে পরিবারের কেউ কেউ এই ‘শেয়ার্ড ডিল্যুশন’-এ আক্রান্ত হয়েই জীবন কাটাচ্ছিলেন বলে মনে করছেন মনোবিদেরা।

কেন এমন হয় ? জয়রঞ্জনবাবুর মতে, সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন পরিবারেই সাধারণত এমনটা বেশি দেখা যায়। এঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব সীমিত। পুলিশ জানতে পেরেছে, গৃহকর্ত্রী আরতিদেবীর মৃত্যুর পরে অরবিন্দ দে-র পরিবারও আত্মীয়-পড়শিদের থেকে নিজেদের পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিল। মনোবিদেরা আরও বলছেন, জিনগত ভাবেও গোটা পরিবার এক ধরনের মানসিক অসুখের শরিক হতে পারে। আবার পরিবারের এক জনের চিন্তাধারা বাকিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সকলেই এক ধরনের অবাস্তব ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে যেতে পারেন। তাঁরা নিজেদের জগৎকে পরিবারের কয়েক জনের মধ্যে আটকে ফেলেন, নানা উদ্ভট বিশ্বাস নিয়ে চলতে থাকেন। কেউ সব কিছুর মধ্যে চক্রান্ত খুঁজে পান। কেউ বা প্রেতচর্চায় মেতে ওঠেন।

বস্তুত রবিনসন স্ট্রিট-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে এমন অনেক কিছুই পুলিশের নজরে এসেছে। অরবিন্দবাবুর ছেলে পার্থ পুলিশকে জানিয়েছেন, প্রথমে পোষা দু’টি কুকুর মারা যাওয়ার পরে তিনি ও দিদি কুকুরগুলির দেহ রেখে দিয়েছিলেন। দিদির মৃত্যুর পরে একই ভাবে তাঁর দেহও রেখে দেওয়া হয়। পুলিশের অনুমান, বাড়িতে প্ল্যানচেট ইত্যাদিও চলত। ঘরে এক ধরনের আবহ-সঙ্গীতের মাধ্যমে আধি-ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করা হতো। পার্থের ওই ঘরে বহু বছর পাড়া-পড়শিদের পা পড়েনি বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

এমতাবস্থায় মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘বাইরের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করলে এই বিভ্রমের জগৎ খান খান হয়ে যাবে ভেবেই পরিপার্শ্ব থেকে ওঁরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন।’’ মনোবিদ প্রশান্ত রায় বা মলয় ঘোষালেরাও মনে করছেন, এমন সব ক্ষেত্রে বিভ্রমের বোধটাই ভুক্তভোগীদের তামাম সত্তা অধিকার করে নেয়। যাতে সব আবেগ ভোঁতা হয়ে যায়।

বিভ্রমের ভরে এমন ঘটনা অবশ্য বিশ্ব জুড়ে নানা সময়ে, নানা রূপে দেখা গিয়েছে। যেমন ২০১৩-য় তামিলনাড়ুর নাগেরকয়েলে উমা পিল্লাইয়ের ঘটনা। ৫৬ বছরের মহিলার মৃত্যুর পরে প্রায় দশ মাস পরিজনেরা তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে বসবাস করেছিলেন। গত ডিসেম্বরে কানাডার হ্যামিল্টনে একটি বাড়ির দোতলার শোওয়ার ঘরে পিটার ওয়াল্ডস নামে এক ব্যক্তির কঙ্কাল পাওয়া যায়। জানা যায়, উনি আবার বেঁচে উঠবেন— এই বিশ্বাস নিয়ে স্ত্রী ও পুত্রেরা সাত মাস ধরে দেহ আগলে রেখেছেন। মা বেঁচে উঠবেন, এই আশায় প্লাস্টিক ব্যাগে মৃতদেহ মুড়ে দশ বছর নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিলেন আর্জেন্তিনার এক প্রৌঢ়। ২০১৪-র জানুয়ারিতে কঙ্কালটি উদ্ধার হয়।

মনস্তত্ত্ববিদ পৃথা মুখোপাধ্যায় বলেন, কোনও এক জনের সঙ্গে অস্বাভাবিক একাত্মতা থাকলে তাঁর মৃত্যুর পরে অনেকের মনে হয়, নিজেরই অস্তিত্ব লোপ হয়েছে। কঙ্কাল রেখে দেওয়া, কঙ্কালকে খেতে দেওয়ার মতো কাজগুলো আসলে মৃত্যুকে অস্বীকার করতে চাওয়া। মনোবিদ অমিত চক্রবর্তীর মতে, ক’বছর আগে বালক ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পরে যা ঘটেছিল, তা এক ধরনের বিভ্রমই। তাতে অবশ্য রাখঢাক ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত শোকের নিভৃতিতে যা ঘটে, তা সব সময়ে সহজে জানা যায় না।

দে পরিবারের ক্ষেত্রে যেমন যায়নি। পুলিশকে পার্থ জানিয়েছেন, দিদি তাঁর ছিলেন তাঁর ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড। উনি মারা যাননি, তাঁদের সঙ্গে আছেন— এই বিশ্বাস থেকেই তিনি দিদির কঙ্কাল রেখে দিয়েছিলেন। পোষ্য ল্যাব্রাডরদের মৃত্যুর শোকে দিদি খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাই দিদির কঙ্কালের পাশে ভাই রোজ রেখে দিতেন শুকনো ফল, মিষ্টি, পাস্তা, পিৎজা।

মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ প্রদীপবাবু এ-ও বলেন, ‘‘চরম মানসিক বিকারের ঘোরে কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে, প্রিয়জনকে মেরে রেখে দিলেও তাঁরা চিরতরে কাছে থাকবে।’’ রবার্ট ব্রাউনিংয়ের বিখ্যাত কবিতা ‘পরফিরিয়াজ লাভার’-এর মধ্যে এমন চরিত্রের দেখা মেলে। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে পরফিরিয়ার দীর্ঘ সোনালি চুলের ফাঁসে তাঁর গলা জড়িয়ে প্রেমিক তাঁকে হত্যা করে। মনোবিদদের মতে, অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক বিভ্রমে ডুবে থাকার সঙ্গে জুড়ে থাকে এক ধরনের ‘ডিসসোশ্যাল পার্সোনালিটি’ বা অসামাজিক মননও। এমন হিংসা তারই পরিণতি।

দে পরিবারের ঘটনায় এখনও কোনও খুনের প্রমাণ মেলেনি। যদিও পার্থর দিদি কবে, কী ভাবে মারা গিয়েছেন, তা-ও স্পষ্ট হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE