Advertisement
০৪ মে ২০২৪

সাবেক বাড়ির ভোগ

আরও একটা দুর্গাপুজো এসে গেল। উৎসাহীরা পুজোর দিনে বনেদিবাড়ির ভোগ তৈরি করে পুজোর আনন্দে মেতে উঠতে পারেন। লিখছেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার কাশীপুর চিৎপুর রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী রায়চৌধুরী পরিবারের চিত্তেশ্বরী দেবী দুর্গা মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির। তারও প্রায় এক দশক আগে গঙ্গার ধারের এই অঞ্চলে ঘন জঙ্গল ছিল। সেই সময়কার দুর্ধর্ষ চিতে ডাকাত মায়ের স্বপ্ন পেয়ে এই দুর্গামূর্তি তৈরি করে তার চালাঘরে পুজো শুরু করেছিল।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:০৮
Share: Save:

কাশীপুরের রায় চৌধুরী পরিবার

কলকাতার কাশীপুর চিৎপুর রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী রায়চৌধুরী পরিবারের চিত্তেশ্বরী দেবী দুর্গা মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির। তারও প্রায় এক দশক আগে গঙ্গার ধারের এই অঞ্চলে ঘন জঙ্গল ছিল। সেই সময়কার দুর্ধর্ষ চিতে ডাকাত মায়ের স্বপ্ন পেয়ে এই দুর্গামূর্তি তৈরি করে তার চালাঘরে পুজো শুরু করেছিল। পরবর্তী কালে জমিদার মনোহর ঘোষ ও নৃসিংহ ব্রহ্মচারী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তারও পরে হালিশহরের জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশধররাই মায়ের দেখভাল করে চলেছেন। বর্তমান প্রজন্মের বংশধর কাশীশ্বর রায়চৌধুরী ও তার স্ত্রী ইন্দ্রা রায়চৌধুরী জানালেন, আজও সেই প্রাচীন দুর্গামূর্তির নিত্যপুজো হয়। ইন্দ্রাদেবী আরও জানালেন, সপ্তমী থেকে নবমী— পুজোর এই তিনদিন মাকে খিচুড়ি, আলু-পটলের ডালনা, ছ্যাচড়া, পোলাও, চাটনি, পায়েস, বোঁদে ও রকমারি মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়। শুধু সপ্তমী ও নবমীর দিনে মাকে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া রুইমাছের পদ ভোগ হিসাবে দেওয়া হয়। ইন্দ্রা রায়চৌধুরীর সহযোগিতায় ভোগের রেসিপি জানানো হল।

চিত্তেশ্বরী মন্দিরের রুইমাছ ভোগ: বড় সাইজের পাকা রুইমাছ বড় বড় পিস করে কেটে নিতে হবে। ১ কেজি মাছে ১৫টি পিস করতে হবে। মাছের গায়ে আন্দাজমতো নুন-হলুদ মাখিয়ে ছাঁকা তেলে মাছগুলো ভেজে নিন। ভাজা হলে তেল ঝরিয়ে আলাদা রাখুন। অন্য কড়ায় ১০০ গ্রাম সর্ষের তেল গরম করে ১ চামচ সাদা জিরে, ৪টে কাঁচালংকা, ৪টে তেজপাতা ফোড়ন দিন। আদা, জিরে ও ধনে একসঙ্গে বেটে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। ভাতের হাতার এক হাতা এই মিশ্রণ কড়ায় দিয়ে নেড়ে ও কষে, ওর মধ্যে একটা বড় টমাটো কুচি করে দিয়ে, আন্দাজমতো হলুদ ও নুন দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে থাকুন যতক্ষণ না তেল ছাড়ছে। তেল ছাড়লে ওর মধ্যে আন্দাজমতো চিনি দিয়ে নেড়ে মিশিয়ে পরিমাণমতো জল ঢেলে দিন। জল ফুটে উঠলে ওর মধ্যে ভাজা মাছগুলো দিয়ে নিভু আঁচে রান্না করুন। ঝোল ঘন হয়ে গা মাখামাখা হলে গোটা গরমমশলা (এলাচ-দারচিনি-লবঙ্গ-জায়ফল) বাটা ১ বড় চামচ ও ২ বড় চামচ গাওয়া ঘি ছড়িয়ে নেড়ে মিশিয়ে আঁচ থেকে নামিয়ে নিন।

জোড়াসাঁকোর দাঁ-বাড়ির পুজো

জোড়াসাঁকোর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যশালী বন্দুকওয়ালা দাঁ-পরিবারের দুর্গাপুজোর যথেষ্ট খ্যাতি। দাঁ-পরিবারের বর্তমান বংশধর সুদীপ দাঁ ও সুব্রত দাঁ জানালেন, ১৮৫৯ সালে পরিবারে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। এখনও সেই ঐতিহ্য মেনে পুজো করা হয়। সুদীপবাবু জানান, সপ্তমী থেকে নবমী, দুর্গামাকে লুচি, মিহিদানা, লম্বা লেডিকেনি, বালুসাই, গজা, নারকেল নাড়ু, ক্ষীর, রাবড়ি, দই, চন্দ্রপুলি, চাল ও রকমারি ফলের নৈবেদ্য ভোগ দেওয়া হয়। এখনও অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় কামান দাগা হয় ও বন্দুক ফাটানো হয়। সুদীপ ও সুব্রত দাঁয়ের সহযোগিতায় রেসিপি জানানো হল।

দাঁ-বাড়ির রাবড়ি প্রসাদ: একটা বড় কড়াই উনুনে চাপিয়ে তার মধ্যে ৪ কেজি দুধ ঢেলে বেশি আঁচে ক্রমাগত নাড়তে থাকুন। দুধ ফুটে উঠলে আঁচটা কম করে দিন। এর পর হালকা করে দুধ ফোটান। এক হাতে হাতপাখা নিয়ে মধ্যম গতিতে দুধের ওপর নাড়তে থাকুন। অন্য হাতে লম্বা কাঠির সাহায্যে দুধের সরগুলো তুলে কড়ার গায়ের চারদিকে লাগিয়ে রাখুন। এইভাবে যখন দেখা যাবে ৪ কেজির মধ্য থেকে ১ কেজির মতো দুধ কড়ায় অবশিষ্ট আছে, তখন আঁচ থেকে নামিয়ে আন্দাজ বা পরিমাণমতো চিনি দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। চিনি মিশে গেলে আঁচ থেকে নামিয়ে নিন। কড়ার গায়ে লাগানো সরগুলো টিপে দেখে নিন। সরগুলো শক্ত হয়ে এলে ছুরির সাহায্যে চারকোনা করে কেটে, দুধের মধ্যে ছড়িয়ে দিন। ভাল করে দুধের মধ্যে সরগুলো মেশান। একটি পাত্রে তুলে ঠান্ডা করুন।

শোভারাম বসাক স্ট্রিটে বসাক বাড়ি

বড়বাজারের শোভারাম বসাক স্ট্রিটের ৩০০ বছরের প্রাচীন বসাক পরিবারে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী পুজো মহাসমারোহে হয়ে আসছে। বর্তমান প্রজন্মের দুই পুত্রবধূ রমা বসাক ও ডলি বসাক জানালেন, রাধাকৃষ্ণ বসাক বংশের প্রথম পুজো চালু করেন। ডলিদেবী বলেন, সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ভোগ দেওয়া হয়। লুচি, ৫ রকমের ভাজা, কুমড়োর ছক্কা, আলুর দম, বাঁধাকপির তরকারি, ঘুগনি, পাঁচকড়াই মাখা, ছোলার ডাল, ধোঁকার ডালনা, পাঁপরভাজা, প্লাস্টিকের ও খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি, হালুয়া ও রকমারি মিষ্টি ও ফল মাকে ভোগ দেওয়া হয়। রমা ও ডলি বসাকের সহযোগিতায় পাঁচকড়াইয়ের রেসিপি দেওয়া হল।

বসাকবাড়ির পাঁচকড়াই ভোগ: একটি বড় পাত্রে জল নিয়ে, তার মধ্যে ৫০ গ্রাম ছোলা, ৫০ গ্রাম গোটা মুগ (সবুজ), ৫০ গ্রাম মটরদানা, ৫০ গ্রাম কাবুলিছোলা, ৫০ গ্রাম বরবটির দানা দিয়ে এক রাত্রি ভিজিয়ে রাখুন।

১০০ গ্রাম কালো সর্ষে ও ২৫ গ্রাম লঙ্কা বেটে মিশ্রণ তৈরি করে নিন। একটি বড় পাত্রে ভেজানো ছোলা, গোটা মুগ, মটর, কাবুলি ছোলা, বরবটির দানা রেখে, তার মধ্যে সর্ষে ও লঙ্কা বাটা, ৫০ গ্রাম সর্ষের তেল, ২টি পাতিলেবুর রস ও নুন দিয়ে হাত দিয়ে খুব ভাল করে মেখে নিন।

অম্বিকা-কালনার সেন বাড়ির পুজো

প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন অম্বিকা-কালনার ঐতিহ্যবাহী সেনপরিবারের দুর্গাপুজো। সি কে সেন জবাকুসুম বাড়ির পুজো হিসেবে এটি খ্যাত। আজও পরিবারের সদস্যরা প্রাচীন প্রথা ও ঐতিহ্য বজায় রেখে নিষ্ঠাসহকারে দুর্গাপুজো পালন করে চলেছেন। পুজোতে অন্নভোগ প্রদান করা হয় না। ঘিয়ের লুচি, বোঁদে, মিহিদানা, পান্তুয়া, গজা, মাখাসন্দেশ, কমলাভোগ-সহ মোট ১০ রকমের মিষ্টি ও রকমারি ফল সহযোগে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হয়।

সেন পরিবারের বোঁদেভোগ : একটি বড় পাত্রে ১ কেজি ছোলার বেসন ও ৫০ গ্রাম চালের গুঁড়ো নিয়ে হাত দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। ওর মধ্যে এক লিটারের একটু বেশি জল দিয়ে হাত দিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে গোলা তৈরি করে নিন। এই বেসনের গোলাটা মিনিট দশেক খোলা হাওয়ায় আলাদা করে রেখে দিন।

কড়া আঁচে বসিয়ে দেড় কেজি দেশি ঘি গরম করে নিন। ঘি গলে গেলে কড়ার মাঝখানে ছান্তা রেখে এক হাতে গোলা বেসনটা একটা ভাল পাত্রের মধ্যে ভরে ছান্তার মধ্যে ঢালতে হবে। অন্য হাতের সাহায্যে ছান্তাটা ঠুকতে হবে যাতে বোঁদের দানাগুলো ঘিয়ের মধ্যে পড়ে। ভাল করে নেড়ে বোঁদে মুচমুচে করে ভেজে নিন। লালরং হবার আগে কড়া থেকে তুলে, অতিরিক্ত ঘি ঝরিয়ে নিয়ে, অন্য একটি ডেকচির মধ্যে ভাজা বোঁদেগুলো ঢেলে ঢাকনা বন্ধ করে এক ঘণ্টা রেখে ঠান্ডা করুন।

অন্য একটি কড়া আঁচে বসিয়ে ৫০০ গ্রাম জল, ৫০০ গ্রাম চিনি, ১ চা-চামচ কেশর রং নিয়ে হাতার সাহায্যে নেড়ে ভল করে ফোটান। ফেনাগুলো তুলে ফেলে দিন। রস মাঝারি ঘন হয়ে এলে (মানে না-ঘন না-পাতলা) ওর মধ্যে ভাজা বোঁদেগুলো দিয়ে একবার ফুটিয়ে নিয়ে হাতার সাহায্যে নেড়ে নেড়ে আঁচ থেকে নামিয়ে নিন। নামানোর আগে চাইলে ৫০ গ্রাম গাওয়া ঘি ঢেলে দিতে পারেন। এবার কড়া আঁচ থেকে নামানোর পর ঢাকনা বন্ধ করে কিছুক্ষণ রেখে দিন। ১৫-২০ মিনিট বাদে ঢাকনা খুলে দেখুন বোঁদেগুলি রসে চুবে নরম হয়ে গেছে কি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

puja legacy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE