Advertisement
০৬ মে ২০২৪

নিবেদিতার স্মৃতি সাজিয়ে তৈরি বাগবাজারের ১৬, বোসপাড়া লেন

বাগবাজারের ১৬ নম্বর বাড়িকে ঘিরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের সব স্মৃতিই আজও জাগিয়ে রাখতে চায় রামকৃষ্ণ সারদা মিশন।

স্মরণীয়:  বোসপাড়া লেনের সেই বাড়ির ছাদে ভগিনী নিবেদিত। ছবি: সংগৃহীত।

স্মরণীয়: বোসপাড়া লেনের সেই বাড়ির ছাদে ভগিনী নিবেদিত। ছবি: সংগৃহীত।

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০০:৫৬
Share: Save:

সালটা ১৮৯৯। জানুয়ারির শেষের এক শনিবার, সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। আচমকা পুরনো দিনের এক বাড়ি থেকে ভেসে এল ‘এসো শান্তি’।

বাগবাজারের ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িতে কে গেয়েছিলেন সেই গান? মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে নিবেদিতা জানিয়েছিলেন, তাঁর আহ্বানে বাড়ির উঠোনের চা-চক্রে সেই গান গেয়েছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সামনে তখন মন্ত্রমুগ্ধ স্বামী বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রলাল সরকার, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়-সহ আরও কয়েক জন।

১২০ বছরের পুরনো সেই স্মৃতি বয়ে চলেছে বোসপাড়া লেনের ওই বাড়ি। যেখানে ছোট ইটের গাঁথনির ঠাকুর দালানে আজও জেগে ১৮৯৮-র ১৩ নভেম্বর। রবিবারের সেই সকালে বাড়ির সদরে বসেছিল মঙ্গলঘট।

সব কিছুর তদারকিতে ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। কালীপুজোর তিথিতে সেই ঠাকুর দালানে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দের উপস্থিতিতে নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেছিলেন মা সারদা।

১৮৯৮-র নভেম্বরে নিবেদিতা ওই বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার পরে তাঁর ডাকে একাধিক বার সেখানে এসেছিলেন মা সারদা। ১৮৯৯-র জুনে স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে নিবেদিতা বিদেশে যান। ১৯০০-র নভেম্বর থেকে প্রায় এক বছর এক মাস ওই বাড়িতে ভাড়া ছিলেন মা সারদা। আড়াই বছর পরে শহরে এসে পাশের ১৭ নম্বর বাড়ি ভাড়া নিলেও নিজের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটাতে ১৯০৪-এ ফের ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িটি ভাড়া নেন নিবেদিতা। পুরসভার হেরিটেজ কমিটির তরফে ১৭ নম্বরের জায়গাটিও হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে।

সেজে ওঠা বাড়ির চৌহদ্দি। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

বাগবাজারের ১৬ নম্বর বাড়িকে ঘিরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের সব স্মৃতিই আজও জাগিয়ে রাখতে চায় রামকৃষ্ণ সারদা মিশন। ২০১৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িটি তাদের হাতে তুলে দেওয়ার পরে সেখানে ‘ভগিনী নিবেদিতা সংগ্রহশালা’ তৈরির পরিকল্পনা করেন সারদা মিশন কর্তৃপক্ষ। বাগবাজারের গিরিশ অ্যাভিনিউ থেকে ডান দিকে ঢুকে বোসপাড়া লেনের পাঁচ কাঠা জমির উপরে ওই বাড়িতে দু’টি উঠোন, কিছুটা অংশ দোতলা, বাকিটা একতলা। নিবেদিতাও তাঁর লেখায় বাড়িটিকে হিন্দু স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন বলেই উল্লেখ করেছেন।

কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটি ও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পরামর্শে ২০১৪-র ৩ মার্চ থেকে বাড়ি সংরক্ষণ শুরু হয়। আর্থিক সহায়তা করে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক। মুর্শিদাবাদ থেকে আসেন দক্ষ নির্মাণকর্মী। তিন বছর ধরে চলে কাজ। নিবেদিতার বাড়ির দায়িত্বে থাকা প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণা জানান, চুন-সুরকির তৈরি বাড়িতে প্লাস্টার খসাতেই দেখা গেল, ভিতরে অনেক ক্ষতি হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে বাড়িটির নকশায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল। বাড়িটিকে পুরনো রূপে ফেরাতে সংযোজিত অংশ ভাঙা হয়। কিছু জায়গায় ছোট আকৃতির কিছু ইটও নষ্ট হওয়ায় পুনরায় তা বানিয়ে ব্যবহার হয়েছে। আর্দ্রতা কাটাতে ইটকে ডোবানো হয়েছে রেড়ির তেলেও। নতুন ভাবে তৈরি ছাদে ঘোলা ঢালতে ব্যবহার হয়েছে গুড়, মেথি, খয়ের, হরিতকি ও বেলের তৈরি মিশ্রণ। শেষ পর্যায়ে দেওয়ালের শোভা বাড়াতে শামুকের খোল থেকে তৈরি চুন, বালির সঙ্গে কয়েক হাজার ডিমের সাদা অংশ ও ঘি-এর মিশ্রণ ব্যবহার হয়েছে।

‘‘পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণার জন্য অনেক পড়ুয়াই এখন এই বাড়িতে আসেন’’, বললেন প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণা। বর্মা-সেগুন কাঠের সদর দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেই ডান হাতে নিবেদিতার পড়ার ঘর। তার পরেই ঠাকুর দালানের সামনে ছোট্ট উঠোন। যেখানে গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সামনে আরও দু’টি ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলে ঢোকার আগেই ফের ছোট্ট উঠোন ও ঘর। সেখান দিয়েই উঠেছে দোতলায় ওঠার অপরিসর সিঁড়ি। সংগ্রশালায় আসা দর্শকদের জন্য অবশ্য নতুন সিঁড়ি বানানো হয়েছে। দোতলা থেকে একতলা সর্বত্রই থাকছে নিবেদিতার জীবন ও সমাজসংস্কারের বিভিন্ন দিক এবং স্মৃতির নিদর্শন। রয়েছে সারদা মঠ তৈরির ইতিহাসও।

শহরের বুকে নিবেদিতার স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে প্রস্তুত ১৬ নম্বর, বোসপাড়া লেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sister Nivedita Heritage History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE