Advertisement
০৩ মে ২০২৪

আগুনের ‘জয়গান’ সল্টলেকেও

সিজিও কমপ্লেক্সের তিনতলা। অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রের গায়ে মেয়াদ ফুরনোর স্টিকার কার্যত অস্পষ্ট। খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বোঝা গেল, মাস কয়েক আগেই মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে যন্ত্রগুলির। নতুন স্টিকার লাগানো হয়নি। অর্থাৎ, নতুন করে যন্ত্রে ভরা হয়নি আগুন নেভানোর রাসায়নিক।

মেয়াদ-উত্তীর্ণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়েই চলছে সল্টলেকের অধিকাংশ সরকারি ভবন। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

মেয়াদ-উত্তীর্ণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়েই চলছে সল্টলেকের অধিকাংশ সরকারি ভবন। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

কাজল গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩০
Share: Save:

সিজিও কমপ্লেক্সের তিনতলা। অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রের গায়ে মেয়াদ ফুরনোর স্টিকার কার্যত অস্পষ্ট। খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বোঝা গেল, মাস কয়েক আগেই মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে যন্ত্রগুলির। নতুন স্টিকার লাগানো হয়নি। অর্থাৎ, নতুন করে যন্ত্রে ভরা হয়নি আগুন নেভানোর রাসায়নিক।

বিকাশ ভবন। শিক্ষা-সহ রাজ্য সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতর রয়েছে এখানে। ঘুরেফিরে দেখে জানা গেল, অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রগুলির কোনওটির মেয়াদ ২০১৩ সালে ফুরিয়েছে। কোনওটির ২০১৪ সালে।

সল্টলেকের অফিসপাড়া আলো করে রয়েছে সেচ ভবন, ময়ূখ ভবন, উন্নয়ন ভবন, বিধাননগর পুরনিগমের সদর দফতর। কিন্তু আগুন ঠেকানোর ব্যবস্থা এখনও স্বাবলম্বী হয়নি এই বাড়িগুলির। সর্বত্র বসানো হয়নি স্প্রিঙ্কলার। দমকলের জন্য আলাদা করে জলের ব্যবস্থাও সর্বত্র নেই। কর্মীদের নিয়মিত ‘মক ড্রিল’ হয় না।

বিধাননগরকে ‘স্মার্ট সিটি’ করতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার। কিন্তু সেই বিধাননগরের অফিসপাড়ার অগ্নি-সুরক্ষার এমন হাল কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের অন্দরেই। ওই সব অফিসের কর্মীদেরই একাংশের বক্তব্য, সুরক্ষার এমন হাল নিয়ে দফতরের কর্তারাও ওয়াকিবহাল। তবু বছরের পর বছর এমন ভাবেই বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকে নিরাপত্তার যন্ত্রপাতি।

শহরের আগুন-স্মৃতি

বড়বাজারের নন্দরাম মার্কেট। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে গিয়েছিল বাজার। শহরের ব্যবসা কেন্দ্রের বহুতলে অগ্নি-নিরাপত্তার বেহাল দশা সামনে এসেছিল। অগ্নিবিধি মোকাবিলায় পুলিশ, দমকল, পুরসভাকে নিয়ে বিশেষ কমিটি গড়া হয়েছিল। প্রশাসন বলেছিল, শহরের সব বহুতলে অগ্নি-নিরাপত্তা বিধি লাগু করায় জোর দেওয়া হবে।

২০১০ সালের মার্চ মাস। ফের আগুন লাগল পার্ক স্ট্রিটের বহুতল স্টিফেন কোর্টে। মারা গেলেন ৪৩ জন। ফের বেআব্রু হয়ে পড়ল শহরের বহুতলে অগ্নি-নিরাপত্তার বেহাল দশা। পুলিশ-দমকল-পুরসভার কমিটি কী কাজ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল সমাজের নানা মহলে।

২০১১ সালের ডিসেম্বর। এ বার আগুন ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন ৯৩ জন। যাঁদের বেশির ভাগই ওই হাসপাতালের রোগী। দেখা যায়, নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্টের পরে পুলিশ-দমকলের যে আশ্বাস ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। সমালোচনার মুখে পড়ে প্রশাসন শহরের হাসপাতাল, বহুতলে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা শুরু করে। তার পরে ধীরে ধীরে থিতিয়ে গিয়েছে পরিদর্শন। তার ফলে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটে আগুন লেগে ১৮ জনের মৃত্যু। গত কয়েক বছরে হাতিবাগান বাজারেও একাধিক বার আগুন লেগেছে।

বিধাননগরের ছবি

সিজিও কমপ্লেক্স জুড়ে প্রচুর কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস। নিয়ম মেনে অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র লাগানো রয়েছে। কিন্তু মূল ভবনের তিন ও পাঁচতলা-সহ কিছু জায়গায় লাগানো বহু অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রের মেয়াদ ফুরিয়েছে। তবে এই কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে বছরে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মীদের দিয়ে মক-ড্রিল করা হয়। বসানো হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতিও। কিন্তু সেচ ভবন, ময়ূখ ভবন, উন্নয়ন ভবন, বিধাননগর পুরভবনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরের অফিস রয়েছে। অগ্নি-নিরাপত্তায় স্প্রিঙ্কলার বসানো হলেও তা সব জায়গায় নেই। ওই সব অফিসের বেশ কিছু জায়গাতেও অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রের মেয়াদ ফুরিয়েছে। দমকল সূত্রে বলা হয়েছিল, বহুতলগুলিতে নিজস্ব অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি কর্মীদেরও একটি ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফায়ার সেফটি অফিসারের পাশাপাশি নিয়মিত ‘মক-ড্রিল’ করতে হবে।

সরকারি কর্মীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পরে এ সব নিয়ে নড়াচড়া হয়েছিল। যন্ত্রপাতি লাগানো, অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা বসানোর কাজ হয়েছিল। দু’-এক বার মক-ড্রিলও হয়েছে। তার পরে থিতিয়ে গিয়েছে সব। ময়ূখ ভবনের এক কর্মী বলেন, ‘‘মক-ড্রিল হলেও তাতে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হত না।’’ বিকাশ ভবনের বিভিন্ন জায়গায় যেমন রান্না করে খাবার বিক্রি হয়। তা সত্ত্বেও আগুন নেভানোর ব্যবস্থার বেহাল দশা। কোনও কোনও অফিসে দেখা গিয়েছে, অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রের উপরে পুরু ধুলোর আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। কোথাও রং উঠে গিয়েছে যন্ত্রের। দেখেই বোঝা যায়, বহু দিন কারও হাত পড়েনি যন্ত্রগুলোয়!

এই সব অফিসের মধ্যে তুলনায় ভাল অবস্থায় জলসম্পদ ভবন। সেখানে দমকলের আলাদা জল সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রগুলির রক্ষণাবেক্ষণও যথাযথ। নিয়মিত মহড়াও হয়েছে সেখানে। যদিও কর্মীদের একাংশের বক্তব্য, বছরে কয়েক বার মহড়া দিলেও আগুন নেভানোর কাজে প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকায় অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। গোটা বিধাননগরে দমকলের জন্য আলাদা করে জলের উৎস তৈরি করা হয়নি।

বিধাননগরের গা ঘেঁষেই রয়েছে নবদিগন্ত শিল্পনগরী। সল্টলেক পাঁচ নম্বর সেক্টর। নামের সঙ্গে সল্টলেক জুড়ে থাকলেও এর দায়িত্ব নবদিগন্ত শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষের। ওই জায়গায় বেসরকারি অফিসগুলির অগ্নি-নিরাপত্তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। তার উপরে নিয়মিত নজরদারিও হয়।

ফায়ার অডিট

কোনও বাজার বা বহুতলের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তা সরেজমিন খতিয়ে দেখাকেই বলা হয় ‘ফায়ার অডিট’। শহরে বড় অগ্নিকাণ্ডের পরে দমকল ‘ফায়ার অডিট’-এর সুপারিশ করেছিল। বিধাননগরের সরকারি দফতরে কোনও ‘ফায়ার অডিট’ হয়নি বলেই প্রশাসন সূত্রের খবর। সরকারি দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘ফায়ার অডিট করলে অগ্নি-নিরাপত্তার বেহাল দশাটা বেআব্রু হয়ে পড়ত।’’ পাঁচ নম্বর সেক্টরের অফিসগুলিতে ইতিমধ্যেই ‘ফায়ার অডিট’ করিয়েছেন নবদিগন্ত কর্তৃপক্ষ। প্রতি বছরই এই অডিট করানো হয় এই দাবি করে শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষের এক কর্তা বলেন, ‘‘এর ফলে অফিসগুলিতে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থার কী হাল, সে সম্পর্কে আমরা জেনেছি। তার পরে কোথায় কোথায় কী কী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে, সে সম্পর্কেও অফিসগুলিকে নির্দেশ দেওয়া সম্ভব হবে।’’

কী বলছেন কর্তারা

সিজিও কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরের আধিকারিকেরা বলছেন, সম্প্রতি অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রে নতুন করে আগুন নেভানোর রাসায়নিক ভরা হয়েছে। কিছু বাকি থাকলেও দ্রুত সেগুলিও রিফিল করা হবে। মেয়াদ ফুরনোর ব্যাপার তাঁরা জানেন। এক কর্তার কথায়, ‘‘আমাদের ফায়ার অডিট করা হয়। পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্র বসানো, কর্মীদের দিয়ে মক-ড্রিল করানো, আলাদা করে জলের ব্যবস্থা হয়। তা ছাড়া একাধিক প্রবেশপথ রয়েছে, যেগুলি যথেষ্ট চওড়া।’’ তবে যে সব জায়গায় বিভিন্ন নথি রয়েছে, সেই সব তলে স্প্রিঙ্কলার লাগানো হয় না, তার বদলে আরও উন্নত যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়।

একই সুর সেচ ভবন, ময়ূখ ভবন, উন্নয়ন ভবনের কর্তাদের। তাঁদের একাংশের ব্যাখ্যা, ওই দফতরগুলির সিঁড়ি এবং ঢোকা-বেরোনোর পথ চওড়া। ফলে আগুন লাগলে প্রাণহানির আশঙ্কা কম। যদিও আগুনে সম্পত্তিহানির আশঙ্কা কেন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, তা বোঝা যায়নি।

দমকলের অফিসারেরা বলছেন, তাঁদের সব পরামর্শ সল্টলেকের সরকারি দফতর মানছে না। এই সমস্যার কথা স্বীকার করে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলছেন, ‘‘যে সব জায়গা থেকে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি, সেখানে চিঠি পাঠানো কিংবা পদক্ষেপ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিটি জায়গার উপরে নজরদারি করার মতো পরিকাঠামো নেই।’’ বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘‘শুধু দমকলের জন্য আলাদা করে জলের ব্যবস্থা গড়া নয়, সব মিলিয়ে বিধাননগরের জন্য একটি সুসংহত পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE