Advertisement
E-Paper

‘রাজ্যটা ছারখার হবে’ হাহাকার হাসপাতালে

রক্তমাখা ট্রলিগুলো এক মুহূর্তও ফাঁকা যাচ্ছিল না। অ্যাম্বুল্যান্স থেকে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত এক একটা দেহ নামিয়ে ইমার্জেন্সিতে ঢোকানোর পরের মুহূর্তেই আবার খালি ট্রলি নিয়ে কর্মীরা ছুটছিলেন পরের জনকে আনতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪২
শোকে-ক্ষোভে। বৃহস্পতিবার, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। — পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শোকে-ক্ষোভে। বৃহস্পতিবার, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। — পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

রক্তমাখা ট্রলিগুলো এক মুহূর্তও ফাঁকা যাচ্ছিল না। অ্যাম্বুল্যান্স থেকে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত এক একটা দেহ নামিয়ে ইমার্জেন্সিতে ঢোকানোর পরের মুহূর্তেই আবার খালি ট্রলি নিয়ে কর্মীরা ছুটছিলেন পরের জনকে আনতে। ইমার্জেন্সির সিঁড়ি থেকে শুরু করে ভিতর পর্যন্ত, চারপাশে চাপ চাপ রক্ত। ট্রলির উপরে, মেঝেয়, শয্যায় পরপর থেঁতলে যাওয়া শরীর। কেউ নিথর। কারও দেহ তখনও অল্প কাঁপছে। কারও মাথা বা শরীরের অন্য কোনও অংশ খুলে বেরিয়ে আসছে। কারও কোমরের নীচ থেকে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে ফিরে এসেছে এই ছবিই।

একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকছে। কোনওটা থেকে এমনই থেঁতলানো দেহ নামানো হচ্ছে, যেগুলি গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে বার করতে হয়েছিল। ফলে শরীর থেকে তখনও ধোঁয়া এবং পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। এমনই দু’টি দেহ শনাক্ত করে ইমার্জেন্সি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলেন এক তরুণ। ছ’ফুটের উপরে লম্বা। ভাল করে হাঁটতেও পারছিলেন না। তাঁকে ধরে হাসপাতাল চত্বরে গাছতলায় বসালেন পরিজনেরা। ওই তরুণ, বছর পঁচিশের অভিষেক কানোরি কিছুক্ষণ আগেই এক সঙ্গে বাবা-মাকে হারিয়েছেন।

তাঁর বাবা-মা বড়বাজার মালাপাড়ার বাসিন্দা অজয় ও সরিতা কানোরি এক সঙ্গে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন টাকা তুলতে। আর ফেরেননি। এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বার বার বাবার মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন অভিষেক। পাননি। শেষপর্যন্ত আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে ছুটে এসেছিলেন মেডিক্যালে। সেখানেই বাবা-মায়ের নিথর দেহ শনাক্ত করতে হয়েছে তাঁকে। ছোট ভাই ১৮ বছরের নিখিলকে সামলানোর চেষ্টা করেও শেষরক্ষা করতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালেন অভিষেক।

ইমার্জেন্সির সামনে তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন বাগুইআটির সঞ্জয় জোশী। তাঁর বৃদ্ধা মা আশা জোশী পোস্তায় দাঁতের ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেডিক্যালে তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ খুঁজে পেয়েছেন সঞ্জয়। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্বগতোক্তি করছিলেন, ‘‘কেন মানুষের জীবন নিয়ে এমন ছেলেখেলা করা হয়? টাকা খেয়ে খারাপ জিনিস দিয়ে উড়ালপুল বানিয়ে উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে? এ রাজ্যটা ছারখার হয়ে যাবে।’’

সকালে বাড়ি থেকে নিজের অফিসে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী সঞ্জয় মেহরোত্র। তাঁর বাড়ির লোকজন বারবার ফোন করেও তাঁকে যোগাযোগ করতে পারেননি। শেষ বার অবশ্য ফোনটা ধরেন এক অচেনা ব্যক্তি। তিনিই মেডিক্যালে আসতে বলেন তাঁদের। কাঁপতে কাঁপতে হাসপাতালে এসেছিলেন তাঁর বৌদি এবং দিদি। ইমার্জেন্সিতে ঢুকতেই জোর ধাক্কা। সঞ্জয়ের রক্তাক্ত, নিষ্প্রাণ শরীরটা মেঝেতে শোয়ানো।

মুখ লাল। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ছুটতে ছুটতে ইমার্জেন্সিতে ঢুকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন মৌমিতা শেঠ। নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি তাঁদের পরিবারের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী তপন দত্তকে। একটা থেঁতলানো শরীরের পাশে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়েই জ্ঞান হারান তিনি। বাইরে আনার পরে গোঙাতে গোঙাতে জড়িয়ে ধরেছিলেন দাদা অরিন্দম শেঠকে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য জানা গেল, সন্দেহটা ঠিক। দেহটা তপনবাবুরই। শনাক্ত করল তপনবাবুরই কিশোর ছেলে বুম্বা।

কান্না, হাহাকার, ছোটাছুটির এই ছবির মধ্যেই এ দিন হাসপাতালে অত্যন্ত বেমানান ভাবে মিশে ছিল ভোটের রাজনীতি। দলে দলে শাসক ও বিরোধী দলের নেতারা সমবেদনার ডালি নিয়ে ভিতরে এসেছেন। সপারিষদ ঢুকে পড়েছেন ইমার্জেন্সিতে। ওই ধাক্কাধাক্কিতে ব্যহত হয়েছে চিকিৎসা। চিকিৎসকেরা বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ করায় লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে পাল্টা বাগবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন কোনও কোনও নেতা। সংবাদমাধ্যমের সামনে নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি দেখা গিয়েছে অনেকের মধ্যেই।

তৃণমূলের মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, শশী পাঁজা, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সিপিএমের শ্যামল চক্রবর্তী, সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী, সোমেন মিত্র থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ— সমবেদনা জানানোর রাজনীতিতে বাদ যাননি কেউই। মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি হাসপাতালেও রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, স্মিতা বক্সীরা হাজির ছিলেন দলবল নিয়ে। মেডিক্যালে বিক্ষোভের মুখে পড়েন মেয়র শোভনবাবু। পরে তিনি জানান, ময়নাতদন্তের কাজ যাতে দ্রুত সেরে ফেলা যায়, সে ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করতেই গিয়েছিলেন।

এ দিন হাসপাতালের তরফে সব রকম ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চিকিৎসক-অচিকিৎসক কর্মীরা। সব বিভাগ থেকে কর্মীদের তুলে আনা হয় ইমার্জেন্সিতে। জরুরি ভিত্তিতে বাড়তি শয্যার ব্যবস্থা হয়। চালু হয় অতিরিক্ত অপারেশন থিয়েটারও। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও মেডিক্যালে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘অন্য মেডিক্যাল কলেজ, এমনকী বেসরকারি হাসপাতালগুলিকেও সতর্ক করে দিয়েছি। যেখানে যে আহতই পৌঁছন না কেন, সেখানে তাঁকে সেরা চিকিৎসাটাই দিতে হবে।’’ মেডিক্যালে সার্জারি, অর্থোপেডিক ও অ্যানাস্থেশিয়া বিভাগে সমস্ত চিকিৎসকের ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়।

রাত পর্যন্ত কলকাতা মেডিক্যালে ১১ জনের, আরজিকরে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। ওই হাসপাতালেই ভর্তি থাকা ১৩ জনের মধ্যে ছিলেন তিন জন শ্রমিক। তাঁরা ঢালাইয়ের কাজ করছিলেন। মু্র্শিদাবাদের বাসিন্দা বছর আঠাশের মিলন শেখ বলেন, ‘‘কাজ করতে করতে হঠাৎই মনে হল সেতুটা যেন দুলছে। তার পরেই ভয়ঙ্কর একটা শব্দ। যখন জ্ঞান হল তখন দেখলাম হাসপাতালে শুয়ে আছি।’’ পাশেই শুয়ে জলঙ্গির সুনীল সরকার। এখনও আতঙ্ক কাটেনি। সারা শরীরে একাধিক ক্ষত। মাথায়, পিঠে, কোমরে গুরুতর চোট। এঁদের সঙ্গেই কাজ করছিলেন বছর সাতাশের উজ্জ্বল দাস। বাড়ি মেদিনীপুরে। ডান পায়ে হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত প্লাস্টার করা। মাথায়-হাতে চোট নিয়ে কাতরাচ্ছিলেন রামরাজাতলার বাসিন্দা বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। স্থানীয় মন্দিরের পূজারি। এ দিন সেই কাজ সেরে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক আত্মীয়কে দেখতে যাবেন বলে। তখনই ভেঙে পড়ে উড়ালপুলের একাংশ।

গত বেশ কয়েক বছর ধরে এই উড়ালপুলের পাশেই পানের দোকান গুলাব মালির। এ দিনও সকালে দোকান খুলে বসেছিলেন। মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি হাসপাতালে আনার পথেই মৃত্যু হয় তাঁর। ওই হাসপাতালে মৃত আরও তিন জনের এক জন মহিলা, বাকি দু’জন পুরুষ। ম়ৃতার নাম আশা ঠাকুর। অন্য দু’জনের এক জন ট্যাক্সিচালক সমর ঠাকুর এবং অপর ব্যক্তি হাওড়ার জানাগেটের বাসিন্দা মহাদেব আদক বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়েছে। হাসপাতাল তখনও সারসার ট্রলি নিয়ে অপেক্ষায়। আরও কত দেহ আসা বাকি, সেই আশঙ্কায়।

আরও পড়ুন:
মচমচ শব্দ শুনেই মারলাম এক লাফ

tragedy kolkata flyover collapse
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy