Advertisement
০৩ মে ২০২৪
প্রসঙ্গ স্টেন্ট

এমসিআই-এর নির্দেশের পরেও সুবিচার পাননি রোগী, অভিযোগ

চার বছর আগে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) ‘চিকিৎসায় গাফিলতি’র একটি অভিযোগের ক্ষেত্রে ছ’মাসের মধ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলকে। ছ’মাস তো দূরের কথা, চার বছরেও সেই কাজে এক চুল এগোতে পারেনি কাউন্সিল। হতাশ সেই রোগী এ বার দ্বারস্থ হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৫৩
Share: Save:

চার বছর আগে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) ‘চিকিৎসায় গাফিলতি’র একটি অভিযোগের ক্ষেত্রে ছ’মাসের মধ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলকে। ছ’মাস তো দূরের কথা, চার বছরেও সেই কাজে এক চুল এগোতে পারেনি কাউন্সিল। হতাশ সেই রোগী এ বার দ্বারস্থ হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর প্রশ্ন, বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপরে সরকারের না হয় কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ডাক্তারদের ক্ষেত্রে কোনও অভিযোগ উঠলেও কি তা ধামাচাপা দেওয়াটাই দস্তুর?

বেলেঘাটার বাসিন্দা অমিত ঘোষ হার্টের কিছু সমস্যা নিয়ে রেলের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে দিন কয়েক ভর্তি থাকার পরে তাঁকে রেফার করা হয় বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বিশেষ কিছু চিকিৎসার ক্ষেত্রে রেলের সঙ্গে ওই হাসপাতালের চুক্তি রয়েছে। ওই বেসরকারি হাসপাতালেই কার্ডিওলজিস্ট দেবব্রত রায় তাঁর অ্যাঞ্জিওগ্রাম করেন। অমিতবাবুর অভিযোগ, অ্যাঞ্জিওগ্রামের পরেই দেবব্রতবাবু তাঁর বাড়ির লোকেদের জানান, ধমনীতে যে ব্লক রয়েছে, সেখানে অবিলম্বে স্টেন্ট না বসালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শমতো তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়।

এর কিছু দিন পরে নিজের পরিচিত এক হৃদ্‌রোগ চিকিৎসককে তিনি ওই অস্ত্রোপচারের কথা বলে সেই সংক্রান্ত সিডি দেখান। চিকিৎসক তাঁকে জানান, স্টেন্ট বসানোর কোনও প্রয়োজনই ছিল না তাঁর। অমিতবাবু বলেন, ‘‘আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। রাজ্যের আর এক নামী হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নিতে যাই। সব দেখে তিনিও লিখিত ভাবে জানান, স্টেন্ট বসানোর সিদ্ধান্ত ছিল অপ্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ বিনা কারণে ৪৫ বছর বয়সে আমার শরীরে একটি বাইরের জিনিস ঢোকানো হল, যার জন্য বাকি জীবনটা আমাকে বহু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।’’

এর পরেই মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ায় অভিযোগ জানান অমিতবাবু। এমসিআই ছ’মাসের মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় রাজ্য কাউনসিলকে। রাজ্য কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছে ব্যাখ্যা চান। তার পরে বিষয়টি যায় কাউন্সিলের পেনাল কমিটিতে। বস্তুত, ছ’মাসে পেনাল কমিটিতে এক চুলও সরেনি কেসটি। অমিতবাবু বলেন, ‘‘কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে দেখেছি, ২০১২-এ পেনাল কমিটিতে যে জায়গায় ছিল আমার অভিযোগটি, ২০১৬-এও ঠিক সেখানেই রয়েছে। এমসিআই-এর তরফে রাজ্য কাউন্সিলকে এ ব্যাপারে তিন বার রিমাইন্ডারও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও রাজ্য কাউন্সিল নীরব কেন? কাউন্সিলের সভাপতি নির্মল মাজি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে কাউন্সিলের একাধিক কর্তাই জানিয়েছেন, অভিযোগের নিষ্পত্তি তো দূর, নিয়মিত বৈঠকই হয় না কাউন্সিলে। এ ব্যাপারে একাধিক সদস্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন।

এই পরিস্থিতিতে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরেও বিস্তারিত ভাবে সব কিছু জানিয়েছিলেন তিনি। স্বাস্থ্য দফতর তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ছিল। কিন্তু সেখানে এখনও বিষয়টির কোনও নিষ্পত্তি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর প্রশ্ন, কাউন্সিল তার কাজ বন্ধ রেখেছে। তিন সদস্যের কমিটি কোনও সমাধানের দিশা দেখাতে পারেনি। তাঁর মতো রোগীরা তা হলে কোথায় যাবেন?

অভিযুক্ত চিকিৎসক দেবব্রত রায় বলেন, ‘‘অমিতবাবুর যে পরীক্ষাগুলি হয়েছিল, যে সব উপসর্গের কথা তিনি বলেছিলেন, তার ভিত্তিতেই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয়। চিকিৎসা দু’ধরনের— প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক চিকিৎসা। এ যুগে প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসার উপরেই জোর দেওয়া হয়। ওঁর যে উপসর্গগুলি ছিল, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরে তা আর নেই। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে ওঁর যথেষ্ট উপকার হয়েছে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি না করলে সেই সময়ে ওঁর হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি খুব বেশি ছিল বলেই আমার মনে হয়েছিল।’’

বস্তুত, কোন রোগীর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রয়োজন ও কার নয়, সে নিয়ে বিতর্ক বাধে মাঝেমধ্যেই। এক-এক জন চিকিৎসকের এক-এক রকম মতামতে প্রায়শই বিভ্রান্ত হন রোগীরাও। যে হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক অমিতবাবুর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রয়োজন নেই বলে মতামত দিয়েছিলেন, সেই সত্যজিৎ বসু বলেন, ‘‘হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা যদি ভাল থাকে, ওষুধের মাধ্যমে যদি উপসর্গগুলি কমে থাকে, তা হলে তিনটি করোনারি ধমনীতে ব্লক থাকলেও ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করার পক্ষেই আমি রায় দেব। বাইপাস সার্জারি বা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির চেয়ে সে ক্ষেত্রে ওষুধই ভাল।’’ হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক কিছু নির্দেশিকা ডাক্তারদের মেনে চলতে হয়। সেগুলি মেনে চলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করলে কারওরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গ ইত্যাদি দেখে নির্দিষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক কিছু সিদ্ধান্ত নেন, যা কতটা নির্ভুল সে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।’’

প্রয়োজন ছাড়া অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হলে কী ক্ষতি হতে পারে? বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, শরীরে একটি ‘ফরেন বডি’ বসানোর ঝক্কি তো রয়েছেই। পাশাপাশি, রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ খেয়ে যেতে হয় সারা জীবন। পরবর্তী সময়ে কোনও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে সেই ওষুধ বন্ধ করতে হয়। তখন আবার স্টেন্টে ব্লক হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE