প্রতীকী ছবি।
ঘর অন্ধকার করে সারাক্ষণ এক কোণে বসে থাকত সে। বইয়ের পাতা ছিঁড়ত। কেউ ডাকলেই চিৎকার শুরু করত। সামান্য প্রশ্ন করলেই হাতের কাছে যা পেত তা-ই ছু়ড়ে মারত!
বাবা-মা ভেবেছিলেন মেয়েকে আর বাড়িতে রাখা যাবে না। মানসিক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। ছাড়িয়ে দিতে হবে স্কুলও। কিন্তু সপ্তদশী মেয়েকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়নি। স্কুলের খাতায় নামও কাটা যায়নি তার। বরং প্রধান শিক্ষিকা এবং বাকিদের সাহায্যে এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিল শ্যামবাজারের সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয় এবং শিল্প শিক্ষাসদনের ওই ছাত্রী। শুধু পরীক্ষায় বসাই নয়, ৭৮ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশও করেছে সে। মানসিক রোগ নিয়ে চারপাশে যখন এখনও নানা সংস্কারের অন্ধকার, তখন যে ভাবে গোটা স্কুল তার পাশে দাঁড়িয়েছে, তা নজির হয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন অনেকে।
দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন হঠাৎ একদিন স্কুলে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল ওই ছাত্রী। পরে জানা যায়, অত্যধিক মানসিক চাপ থেকে এই ধরনের সমস্যায় ভুগছে সে। চিকিৎসা পরিভাষায়, ‘ইমপালস কন্ট্রোল ডিসওর্ডার’। এক সময়ে শান্ত করতে ইঞ্জেকশনও দিতে হত তাকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘ওকে কিছুই বলা যেত না। স্কুলের বাকি মেয়েদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে মিশতেও পারত না। বেশ কিছুদিন ছুটিতেও ছিল। ওর পরিবার বলেছিল ও আর পরীক্ষা দেবে না। স্কুল থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন ওঁরা।’’ যদিও শর্মিষ্ঠাদেবী ছাত্রীকে ছাড়তে রাজি হননি। বললেন, ‘‘ও ছোটবেলা থেকেই ভাল পড়াশোনায়। আমার মনে হয়েছিল, কী সমস্যা হচ্ছে সেটা আগে দেখা দরকার। ওকে জোর করেই পরীক্ষায় বসিয়েছিলাম। আজ বড় গর্বের দিন।’’
অবস্থা এমনই ছিল যে, আলাদা বসে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা দিতে হয়েছিল ওই ছাত্রীকে। প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করলেও ফের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয় তার। পরিবারের সদস্যেরা বলছেন, একাদশ শ্রেণিতে স্কুলের পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিল সে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আবার আগের মতো সমস্যা শুরু হয়। জেদ ধরে, কিছুতেই পরীক্ষা দেবে না। পড়ার কথা বলতে গেলেই মারতে শুরু করত অন্যদের। আপাতত মনোরোগ চিকিৎসক উদয় চৌধুরীর অধীনে চিকিৎসাধীন ওই ছাত্রী। উদয়বাবু বলছেন, ‘‘অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগে ওই ছাত্রী। ওষুধ চলছে। কাউন্সেলিংও করানো হয়েছে। ওকে বুঝিয়েছি, জীবনে নিয়মানুবর্তিতাই সব। এখন অনেকটা সুস্থ। পরীক্ষায় ভাল করেছে শুনলাম, দারুণ লাগছে।’’
কী সমস্যা হত তার? রেজাল্ট হাতে বাবা-মায়ের পাশে হাসিমুখে বসা মেয়েকে দেখে তখন বোঝার উপায় নেই, একটা সময়ে কী ঝড় বয়ে গিয়েছে তার উপর দিয়ে। বলল, ‘‘কিছুই ভাল লাগত না। সব বই-খাতা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা করত। খালি মনে হত পরীক্ষায় সবাই ভাল করবে, আমি পারব না।’’ জানাল, ২০১৫ সালে তার বাবা সমীর ঘোষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বুকে সেন্ট বসানো হয়। বাবাকে নিয়ে চিন্তাই তার মন খারাপের বড় কারণ। কিশোরীর কথায়, ‘‘খালি মনে হত, কী করব? কী করে সব চলবে? বাবা তো আর পড়াতে পারবে না। এ সব ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যেত আমার।’’ তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ও ‘ডাক্তারকাকু’ তার জীবন বদলে দিয়েছেন বলে জানাল সে।
কিশোরীর বাবা-মা জানালেন, তাঁরা কৃতজ্ঞ চিকিৎসক এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা বললেন, ‘‘আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছেন ওর স্কুলের হেড মিস। বড় হয়ে ও হেড মিসের মতই ভাল দিদিমণি হোক।’’ আর ছাত্রীর বাবা বললেন, ‘‘মেয়ে সুস্থ থাকুক, শুধু এটুকুই চাই। ওকে বলব, ওর কোনও ভয় নেই। আমরা সবাই আছি ওর সঙ্গে।’’
এখন রাগ কমাতে ‘ডাক্তারকাকু’র শেখানো নানা পদ্ধতি মেনে চলে ওই কিশোরী। সেই পদ্ধতির কয়েকটা দেখাতে দেখাতে বলল, ‘‘রাগ হলে মনে মনে ছোটাভীমের কথা ভাবি। রাগ কেটে গিয়ে হাসি পেয়ে যায়!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy