Advertisement
০৩ মে ২০২৪
ট্যাংরা

সিন্ডিকেটে রাশ না টানলে এই লড়াই অনিবার্য

নিচু জমি ভরাট করতে হবে? রয়েছে সিন্ডিকেট। এলাকায় বহুতল তৈরি করতে বালি বা পাথরকুচি (স্টোন চিপস) চাই? তাতেও রয়েছে সিন্ডিকেট।

আদালতে ধৃতেরা। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

আদালতে ধৃতেরা। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪২
Share: Save:

নিচু জমি ভরাট করতে হবে? রয়েছে সিন্ডিকেট।

এলাকায় বহুতল তৈরি করতে বালি বা পাথরকুচি (স্টোন চিপস) চাই? তাতেও রয়েছে সিন্ডিকেট।

ট্যাংরা এলাকা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্যে উঠে আসছে এমনই সব অভিযোগ। তাঁরা বলছেন, ই এম বাইপাসের অদূরে ওই এলাকায় একের পর এক বহুতল গজিয়ে উঠছে। আর সেই কারবারকে ঘিরেই আসছে কোটি কোটি টাকা। সেই টাকা ধরতে দরকার এলাকার দখলদারি। যা নিয়েই মঙ্গলবার দিনেদুপুরে গুলি-বোমাবাজি শুরু হয়েছিল শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল পুলিশও।

মঙ্গলবারের ওই ঘটনায় গ্রেফতার ৯ জন। বুধবার শিয়ালদহ আদালতে ধৃতদের ২৯ অগস্ট পর্যন্ত পুলিশি হেফাজত দেওয়া হয়। তবে স্থানীয় অনেকেরই আশঙ্কা, এই ধরপাকড়ে কয়েক দিন এলাকা ঠান্ডা থাকলেও গোলমাল পুরোপুরি বন্ধ হবে না। সিন্ডিকেট চক্রে রাশ না টানলে এমন গোলমাল ট্যাংরার আশপাশের এলাকাগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা পুলিশের একাংশেরও।

এলাকার বাসিন্দা ও পুলিশের একাংশ বলছেন, ট্যাংরা ও আশপাশের এলাকায় প্রচুর নিচু জমি রয়েছে। সেখানে বহুতল তৈরি করতে হলে মাটি ফেলে ভরাট করতে হয়। তিন ফুট গভীর নিচু জমি ভরাট করতে প্রোমোটারের সঙ্গে সিন্ডিকেটের চুক্তি হয় কাঠাপ্রতি এক থেকে দেড় লক্ষ টাকায়। ট্যাংরার এক বাসিন্দা জানান, দেবেন্দ্রচন্দ্র দে রোডের আশপাশে বেশ কিছু জমি ভরাট করা হয়েছে। সেগুলির কোনওটায় বহুতল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, কোনওটায় এখনও শুরু হয়নি। এই কাজে এক-একটি নির্মাণস্থলে অন্তত পাঁচ থেকে সাত লক্ষ টাকা লাভ থাকে। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ভরাটের কাজে কিছু ঝামেলাও থাকে। তাই প্রোমোটারেরাও জানেন সিন্ডিকেট চক্র বা তার চাঁইদের খুশি না রাখলে কাজ করা যাবে না। ‘‘নির্ঝঞ্ঝাটে কাজ সারতে তাই ভরাটের বরাত সিন্ডিকেটকেই দেওয়া হবে। এলাকায় যে সিন্ডিকেটের দাপট কায়েম হয়, তারাই একচেটিয়া বরাত পায়’’, বলছেন ওই পুলিশ অফিসার।

ট্যাংরার বাসিন্দা ও পুলিশের একাংশ বলছেন, জমি ভরাটের কারবারে জুড়ে রয়েছে নির্মাণস্থলে বালি ও পাথরকুচি সরবরাহের ব্যবসাও। ট্যাংরা ও আশপাশের এলাকায় একের পর এক বড় মাপের বহুতল নির্মাণ হচ্ছে। সে সব জায়গায় পাথরকুচি ও বালির বরাত মানে কম করে দশ লক্ষ টাকার কারবার। তবে এলাকায় দখল না থাকলে বরাত পাওয়া কঠিন। এলাকার অনেকের মতে, নিচু জমি ভরাটের কাজ ধরতে পারলে ওই জমিতে বহুতল তৈরির কাজের বরাতও প্রায় পাকা। ট্যাংরা ছাড়িয়ে এন্টালি, তিলজলাতেও নির্মাণ ব্যবসার রমরমা। সেখানেও এ ভাবে গোলমালের চোরাস্রোত বইছে বলে দাবি পুলিশের।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই সব সিন্ডিকেটের প্রধান দু’টি গোষ্ঠী রয়েছে। যার একটির নেতৃত্ব দেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা অলোক খাটুয়া ও অন্যটির নেতৃত্ব দেন শাসক দলের আর এক স্থানীয় নেতা প্রদীপ গুহ ও তার ঘনিষ্ঠ মনোজ হাজরা। পুলিশ জানায়, হাঙ্গামার ঘটনায় ট্যাংরা থানার পুলিশ যে এফআইআর করেছে, তাতে অলোক, মনোজ ও প্রদীপের নাম রয়েছে। স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ বলছে, প্রদীপের সঙ্গে কলকাতার এক সাংসদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অলোক এক প্রভাবশালী বিধায়কের ঘনিষ্ঠ। গত পুর-নির্বাচনে এই দুই গোষ্ঠী এক এলাকায় কাজ করেনি। বিবাদ এড়াতে তাদের আলাদা এলাকা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এলাকা দখলের ক্ষেত্রে সেই গোষ্ঠী বিবাদ মেটানো যায়নি। বরং বছর খানেক ধরে চলা বিবাদের চোরাস্রোত মঙ্গলবার প্রকাশ্যে এসেছে।

পুলিশের দাবি, এই গোলমালে ধৃতদের মধ্যে প্রদীপ গোষ্ঠীর লোকেদের পাশাপাশি আছেন অলোক গোষ্ঠীর সদস্যেরাও। স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর স্বপন সমাদ্দার অবশ্য মঙ্গলবারই গোষ্ঠীদ্বন্দের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। এই গোলমালে সিন্ডিকেট ব্যবসার জড়িত থাকার ঘটনা অস্বীকার করে অলোক খাটুয়া বলেন, ‘‘আমি কোনও সিন্ডিকেট চালাই না। এই ঘটনা দু’টি পাড়ার গোলমাল। পুলিশ ইচ্ছে করে আমার নাম জড়িয়েছে।’’ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি এলাকায় জনপ্রিয় বলে অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছে।’’ প্রদীপ গুহের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মনোজ হাজরার ফোনও এ দিন বন্ধ ছিল। তবে মঙ্গলবার মনোজ জানিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রোমোটারি বা নির্মাণ ব্যবসার অভিযোগ ঠিক নয়।

পুলিশের অন্দরের খবর, খাস কলকাতায় দিনেদুপুরে সিন্ডিকেট ব্যবসা নিয়ে এমন গোলমালে অস্বস্তিতে শাসক দলের নেতারাও। ঘটনায় সিন্ডিকেটের যে সব সদস্য জড়িত, তাদের দ্রুত ধরপাকড়ের নির্দেশও এসেছে মঙ্গলবার রাতেই। পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘দোষীদের গ্রেফতার করতে প্রশাসনের উঁচুতলার নির্দেশ এসেছে। কাজেই ধরপাকড়ে আর বাধা নেই।’’

সিন্ডিকেটের চাঁইদেরও কি তা হলে গ্রেফতার করা হবে? বুধবার এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি লালবাজারের কর্তারা। গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate clash tangra lalbazar group police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE