Advertisement
১১ মে ২০২৪
ব্যারাকপুর কমিশনারেট

পুলিশের মাথাব্যথা কিশোর দুষ্কৃতীরাই

মোটরবাইকে হেলান দিয়ে চার কিশোর। পোশাক ও বাইকের মডেল বলছে তারা সচ্ছল পরিবারের। সবার হাতেই স্মার্টফোন, খবরের কাগজ মোড়ানো বিয়ারের বোতলও। সামনে দিয়ে যাওয়া কিশোরী থেকে মধ্যবয়স্কা সব মহিলাকেই চোখ দিয়ে মাপা চলছে অবিরত। সঙ্গে মন্তব্য এবং ইশারা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৫ ০০:০৬
Share: Save:

মোটরবাইকে হেলান দিয়ে চার কিশোর। পোশাক ও বাইকের মডেল বলছে তারা সচ্ছল পরিবারের। সবার হাতেই স্মার্টফোন, খবরের কাগজ মোড়ানো বিয়ারের বোতলও। সামনে দিয়ে যাওয়া কিশোরী থেকে মধ্যবয়স্কা সব মহিলাকেই চোখ দিয়ে মাপা চলছে অবিরত। সঙ্গে মন্তব্য এবং ইশারা।

গত চার-পাঁচ বছর হল এ দৃশ্য পরিচিত ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। তার সঙ্গেই যোগ হয়েছে মোবাইল হাতে, গয়না পরা, নজরকাড়া পোশাকের মেয়ে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা। সব ক্ষেত্রে শ্লীলতাহানিই উদ্দেশ্য এমন নয়। মোবাইল বা গয়না ছিনিয়ে নেওয়া ও সেই সুযোগে গায়ে হাত দেওয়াও অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য। সদ্য আঠেরো বা আঠেরো ছুঁইছুঁই এমন কিছু ছেলেকে নিয়েই আপাতত বিপাকে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের। পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরে এ ধরনের অপরাধের সংখ্যা প্রায় দুশো। সোমবার রাতেও যার সাক্ষী হয়েছে ব্যারাকপুর।

কমিশনারেটের সদর শহরে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসের পাশে ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন আনন্দপুরী এ রোডের বাসিন্দা সাগর নন্দী ও তাঁর স্ত্রী রুষা। সাগর কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকেন। সৌদি এয়ারলাইন্সে বিমানসেবিকার চাকরি পাওয়া রুষার ট্রেনিং চলছে এখনও। ছুটিতে দু’জনে বাড়ি এসেছিলেন গত সপ্তাহেই। বুধবার রুষার ট্রেনিংয়ের কথা ছিল আরবের জেড্ডা-য়। সোমবার তারই কাজ সারতে বেরিয়ে ফুচকা খাওয়ার প্রস্তাব দেন রুষাই। মিনিট দশেক দাঁড়াতে হয়েছিল। তাতেই বিপত্তি।

রাস্তার উল্টো দিকে গাঁজা গলিতে মদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই মদ্যপান করছিল তিন তরুণ। সাগর বলেন, ‘‘হঠাৎই ১৮-১৯ বছরের তিনটি ছেলে আমাকে ধাক্কা মারে। সামনে কিছু স্টোন চিপস ছিল। আমি টাল সামলাতে সামলাতেই রুষার হার ও মোবাইল নেওয়ার চেষ্টা করে ওরা। দু’জনকে ধরে ফেললে ওরা আমাকে মারতে থাকে। রুষার গায়ে হাত দিলে তাদের ছেড়ে দিতে পারি ভেবে তৃতীয় জন সেই চেষ্টাও করে। তবে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই পরিচিত এক জন এগিয়ে আসেন। দু’টি ছেলেকে ধরে পুলিশে দেওয়া হয়।’’

কিরণ রায় ও নিমাই দাস নামে দুই দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে অবশ্য কড়া ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে পুলিশ। মহিলাকে অনুসরণ, শ্লীলতাহানির চেষ্টা, মারধর-সহ একাধিক ধারায় মামলাও হয়েছে। যাতে সহজে জামিন না মেলে। মঙ্গলবার রাতেই জেড্ডা চলে গিয়েছেন রুষা। দিল্লি ফেরার তোড়জোড় করছেন সাগরও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই স্ত্রীর উপর হামলা হতে পারে বুঝেও দু’জনকে ছাড়িনি। তবে ওরা কিছু করতে পারেনি। পুলিশ খুব সাহায্য করেছে। কড়া পদক্ষেপের আশ্বাসও দিয়েছে। এ বার যা করার পুলিশ করবে। বাড়ির লোকও চাইছে না আমরা এর মধ্যে খুব
বেশি জড়াই।’’

মঙ্গলবার রাত থেকে পুলিশ ব্যারাকপুর ও আশপাশের পানশালা ও মদের দোকানে তল্লাশি শুরু করেছে। বাইক ও গাড়িও তল্লাশি শুরু হয়েছে। গত কয়েক বছরে ব্যারাকপুরে কুড়িটিরও বেশি পানশালা ও অসংখ্য মদের দোকান খুলেছে। সেগুলি ঘিরে তৈরি হয়েছে কমবয়সীদের নেশার ঠেক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তা থেকেই মূলত এ ধরনের অপরাধের সূত্রপাত।

কিন্তু কেন এই হাল? কী করে এত টাকা আসছে এই ছেলেদের হাতে?

প্রশাসন সূত্রে খবর, মেট্রো সম্প্রসারণ-সহ নানা প্রকল্পের ঘোষণার জেরে হুহু করে দাম বেড়েছে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া জমির। ফাঁকা জমি আর নেই বললেই চলে। বালির ব্যবসা, প্রোমোটারিতে যুক্ত হওয়া পরিবারের হাতে আচমকা অনেক টাকা আসছে। ফলে বাড়ির ছেলেমেয়েদের নাগালে চলে আসছে বাইক, স্মার্টফোন, ব্র্যান্ডেড পোশাক। দেখাদেখি তাদের বন্ধুরাও তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। পরিবারের সেই সচ্ছলতা না থাকলে তারা হাঁটছে অপরাধের পথে। ছিনিয়ে নেওয়া দামি মোবাইল বেচে উঠে আসছে জিনিসপত্র কেনা বা মদ্যপানের টাকা। বাজি ধরে বাইক রেসে যোগ দিয়েও একলপ্তে বেশ কয়েক হাজার টাকা হাতে পাচ্ছে ব্যারাকপুর, বারাসত, মধ্যমগ্রামের থেকে আসা এই বয়সের বহু ছেলে। অপরাধের জন্য প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড়ের টাকাও থাকছে তাদের হাতে।

সদ্য সাবালক এই দুষ্কৃতীদের রুখতে কী করছে পুলিশ? পুলিশকর্তাদেরই আক্ষেপ, ‘‘ক’জনকে ধরব! কোনও ভাবে প্রভাব খাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। আরও বেশি মাথা উঁচু করে অপরাধ করবে।’’

তবে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ বলেন, ‘‘সোমবার রাতে যা হয়েছে, তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। তবে মোটরবাইকে ছেলেদের দাপট বন্ধ করতে বিভিন্ন জায়গায় নাকা চেকিং ও সাদা পোশাকের পুলিশের টহলদারি বাড়ানো হয়েছে।’’ তিনি আরও জানান, প্রতি মাসে এই বাইক বাহিনীকে ধরে ১৫-২০ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় হচ্ছে। পাশাপাশি, নিয়ম মেনে রাত ১১টায় পানশালা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণ পেতে প্রায় প্রতিটি পানশালায় সিসিটিভি লাগানো হয়েছে বলেও জানান সিপি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE