Advertisement
E-Paper

ঘর জ্বলছে, হঠাৎ সবার খেয়াল হল ঋষি নেই

শুক্রবারই বিজয়গড়ে বৃদ্ধার পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় শহরবাসীর একাংশ প্রশ্ন তুলেছিল অমানবিকতার। ঠিক তার পরদিন, শনিবার সকালে শহর দেখল মানবিকতা ও তৎপরতার উল্টো ছবি। বেহালার জয়শ্রী পার্কে বামাচরণ রায় রোডের বস্তির আগুন নেভাতে জান লড়িয়ে দিলেন স্থানীয়েরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২৭
ঋষি। নিজস্ব চিত্র

ঋষি। নিজস্ব চিত্র

শুক্রবারই বিজয়গড়ে বৃদ্ধার পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় শহরবাসীর একাংশ প্রশ্ন তুলেছিল অমানবিকতার। ঠিক তার পরদিন, শনিবার সকালে শহর দেখল মানবিকতা ও তৎপরতার উল্টো ছবি। বেহালার জয়শ্রী পার্কে বামাচরণ রায় রোডের বস্তির আগুন নেভাতে জান লড়িয়ে দিলেন স্থানীয়েরা। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। বস্তি বাঁচলেও, বিধ্বংসী আগুন কেড়ে নিয়েছে সাড়ে তিন বছরের শিশু কৌস্তুভ রায়ের প্রাণ।

সার দিয়ে বাড়ি, ইটের দেওয়াল। টালি এবং অ্যাসবেসটসের চাল। কোনও কোনও ঘরের উপরে দরমা দিয়ে আরও একটি ঘর বাঁধা হয়েছে। পাশাপাশি দু’টি বাড়ির একটিই দেওয়াল। এ ভাবেই তৈরি প্রায় আড়াইশো পরিবারের বস্তি ৪৭ নম্বর বামাচরণ রায় রোডে।

পুলিশ জানায়, এ দিন সকাল সওয়া আটটা নাগাদ সেখানেই আগুন লাগে। ওই বস্তির বাসিন্দা দেবী সর্দার হঠাৎ দেখেন, তাঁদের পাশের বাড়ির দোতলার মাথায় ধোঁয়া!

কৌস্তুভের ডাকনাম ঋষি। তার দিদি, দশ বছরের রিয়া। দেবী বলেন, ‘‘আমি চিৎকার করে পড়শিদের ডাকতে ডাকতেই দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল ঘরটা। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, ঋষি-রিয়া কোথায়?’’

এলাকা সূত্রের খবর, ঋষি এবং রিয়াকে বাড়িতে রেখে প্রতিদিনই কাজে যান তাদের মা-বাবা। মা মধুমিতা রায় কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, তিনি সাত-আটটা বাড়িতে ঠিকা-পরিচারিকার ও রান্নার কাজ করেন। বাবা বিশ্বনাথ রায় পেশায় গাড়িচালক। এ দিন ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ বিশ্বনাথ বেরিয়ে যান কাজে। রোজকার মতো একটি বাড়িতে রান্নার কাজের জন্য ভোর পাঁচটায় বেরোন মধুমিতাও। ঋষি-রিয়া তখন ঘুমোচ্ছিল। ছ’টা নাগাদ এক বার বাড়ি ফেরেন মধুমিতা। ‘‘ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে তুলে রোজের মতো দুধ-বিস্কুট খাইয়ে ফের বেরিয়ে যাই কাজে। রোজই এ সময়ে বেরিয়ে দুপুর দু’টো-আড়াইটে নাগাদ ফিরি, ওরাও তখন স্কুল থেকে আসে। আজ শনিবার, স্কুল ছিল না। বেরোনোর সময়ে ভাবতেও পারিনি, আর কখনও কোলে নিতে পারব না ছেলেটাকে।’’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বছর তিরিশের মা।

ভস্মীভূত সেই ঘর। নিজস্ব চিত্র

স্থানীয়েরা জানান, বাচ্চা দু’টি অনেক দিন ধরেই এ ভাবেই বাড়িতে থাকতে অভ্যস্ত। আশপাশের বাড়ির সকলেই ওদের ভালবাসেন, দেখভালও করেন। মা-বাবা বাড়িতে না থাকলেও আগে কখনও অসুবিধে হয়নি ওদের। এ দিন এমন ঘটে যাওয়ায় যেন হতবাক যেন গোটা এলাকা। ঋষি-রিয়াদের পড়শি রিমা সর্দার বলেন, ‘‘আগুন দেখামাত্রই সকলে বালতি বালতি জল ছুড়তে থাকি উপরের দিকে। ততক্ষণে সিঁড়িতেও আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল। পাড়ার ছেলেরা মই লাগিয়ে বাইরে থেকে উপরে উঠে যায়। হাতে হাতে বালতি বালতি জল উপরে পাঠিয়ে আগুনে ঢালা হচ্ছিল।’’

স্থানীয়েরা জানান, সেই সময়ে ঋষির দিদি রিয়া বাড়ির সামনের কলতলায় ভাইয়ের কয়েকটা জামা-কাপড় কাচছিল। পাশে খেলছিল ঋষিও। হঠাৎই খেয়াল হয়, দেখা যাচ্ছে না ঋষিকে। সে কোথায়?
উপরে চলে গিয়েছে? কখন উঠল? কাঁদতে শুরু করে দেয় রিয়া। ভাই কি তবে উপরে চলে গেল খেলতে খেলতে? আশঙ্কায় সিঁটিয়ে যান সকলে। তখনও আশা ছিল, আশঙ্কা সত্যি হবে না। হয়তো এ দিক-ও দিক খেলে বেড়াচ্ছে দুরন্ত ছেলেটা। কিন্তু সে আশা বাঁচেনি বেশিক্ষণ।

মই বেয়ে উপরে ওঠা বাবাই ঢালি, বাবু গায়েনরা ততক্ষণে ভেঙে ফেলেছেন দোতলার বেশ কয়েকটা টালি। বাবু বলেন, ‘‘কালো ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। টালি ভাঙার পরে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করতেই দখি লাল হয়ে জ্বলছে ঘরটা। প্রচণ্ড হল্কা পুড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের। কার্নিশে দাঁড়িয়ে তখনও বালতি বালতি জল ঢেলেই যাচ্ছি তখনও।’’ স্থানীয়েরা জানান, চোখ আর শরীর একটু সইতেই মর্মান্তিক দৃশ্যটা দেখতে পান তাঁরা। ঘরের কোণে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে তখন খুদে শরীরটা। ভেজা, ঝলসানো। চামড়া গুটিয়ে হাড়-মাংস বেরিয়ে যাওয়া।

‘‘আমি নিজে হাতে মেঝে থেকে ওকে তুলে মই দিয়ে নামাই। দেখে মনে হচ্ছিল আগুনে হয়তো সরাসরি পোড়েনি, তীব্র তাপে ঝলসে গিয়েছে ছোট্ট ছেলেটা। আমার হাতে ওর উঠে যাওয়া চামড়াগুলো লেগে লেগে যাচ্ছিল। তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছিল ছেলেটা। নামিয়েই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব...,’’ গলা বুজে আসে, বাক্য শেষ করতে পারেন না বাবাই ঢালি।

সঙ্গে সঙ্গে ঋষিকে কোলে নিয়ে রিকশা করে হাসপাতালে ছোটেন প্রতিবেশীরা। মিনিট দশের পথ বিদ্যাসাগর হাসপাতাল। ‘‘বুকে ঘরঘর শব্দ হচ্ছিল, কান লাগিয়ে শুনেছি আমি। ঠোঁটটাও ফাঁক হয়ে ছিল। বড় রাস্তায় পৌঁছনোর আগেই থেমে গেল শব্দ। বুঝতে পেরেছিলাম, শেষ হয়ে গেল,’’ চোখে আঁচল চাপা দেন দেবী। ছোট্ট ঋষিকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসতেন তিনি। আগলেও রাখতেন মায়ের মতোই। হঠাৎ যে কী করে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল, মেনে নিতে পারছেন না কেউই। হাসপাতালে নিয়ে যেতেই ঋষিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

খবর পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছেছিল বেহালা থানার পুলিশ। ততক্ষণে স্থানীয় যুবকেরা আগুন সামলে ফেলেছেন। সকাল ন’টার সময়ে পৌঁছয় দমকল। ততক্ষণে সব শেষ। কিন্তু ঠিক কী থেকে আগুন লাগল তা নিয়ে ধন্দে গোটা বস্তি। পুলিশও কিছু জানাতে পারেনি। ঋষির মা মধুমিতা বলেন, ‘‘এক বার হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছিল ছেলে। তার পর থেকে মশা মারার ধূপ জ্বালাতাম না আর। ঠাকুরের আসনে দেশলাই ছিল, কিন্তু ততটা উঁচুতে হাত পাওয়ার কথা নয় ছেলের। ওর বাবাও বিড়ি-সিগারেট খায় না। জানি না, কী থেকে এত বড় আগুন ধরল ঘরে।’’ প্রাথমিক তদন্তে দমকলের অনুমান, শর্ট সার্কিট থেকেই এই ঘটনা।

দুপুর বারোটা নাগাদ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছন স্থানীয় কাউন্সিলর মানিক চট্টোপাধ্যায়। পৌঁছন ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট) মিরাজ খালিদ। মানিকবাবু বলেন, ‘‘এখানে সকলেই খুব পরিশ্রম করেন। বাবা-মা দু’জনকে কাজে বেরোতে হয়, কিছু করার নেই। এই পরিবারগুলির শিশুদের নিরাপদে রাখার জন্য একটা ক্রেশ গড়ার ভাবনাচিন্তা রয়েছে।’’ পুলিশ জানায়, কী করে এমন আগুন লাগল, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Fire House Child Died
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy