হাসপাতালের শয্যায় (বাঁ দিক থেকে) প্রদীপ্ত দে ও সুদীপ সেন। শনিবার। — নিজস্ব চিত্র।
যে সময়ে প্রকাশ্যে তরুণীকে কুপিয়ে খুন করতে দেখেও কেউ এগিয়ে আসেন না, সেই সময়ে ব্যতিক্রমও হয়। দিল্লির সেই ঘটনায় ওই তরুণী কাউকে পাশে পাননি। তবে শুক্রবার রাতে কলকাতার দুই তরুণী পাশে পেলেন দুই যুবককে। তরুণীদের অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও যাঁরা লড়েছেন দুষ্কৃতীদের সঙ্গে। দুষ্কৃতীদের ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও বাঁচিয়েছেন তরুণীদের। জুনিয়র ডাক্তার ওই দুই তরুণীও পাশ ছাড়েননি আহতদের। নিজেরা অপারেশন থিয়েটারে থেকেছেন। রাত জেগেছেন আহতদের বিছানার পাশে।
পুলিশ জেনেছে, শুক্রবার রাত ১১টা নাগাদ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে দুই তরুণীর পিছু নিয়ে উত্ত্যক্ত করছিল দুই দুষ্কৃতী। ওই দুই তরুণী মেডিক্যালেরই জুনিয়র ডাক্তার। ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে দুই যুবককে দেখতে পেয়ে তাঁরা সাহায্য চান। অসহায় দুই তরুণীর অবস্থা দেখে তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে যান ওই যুবকেরা। তাঁরা দুষ্কৃতীদের চলে যেতে বললে উভয়পক্ষের মারামারি শুরু হয়। ধ্বস্তাধ্বস্তির সময়ে দুই যুবকের পেটে ছুরি মেরে পালায় দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, সে সময়ে আশপাশে প্রচুর লোকজন থাকলেও কেউ ওই যুবকদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। এমনকী, নীরব দর্শক হয়ে ছিলেন হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরাও।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো প্রথম সারির হাসপাতালে যদি সেখানকার দুই ডাক্তারকেই এমন সমস্যায় পড়তে হয়, তা হলে রাতে সরকারি হাসপাতালগুলিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কী নিশ্চয়তা, উঠছে সেই প্রশ্ন। একাধিক স্বাস্থ্যকর্তাই মানছেন, সারা দিন এবং সারা রাত সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অবাধে সকলে ঢুকতে-বেরোতে পারে। কোথাও কোনও তল্লাশি নেই, আটকে দেওয়া নেই। রোগীর বাড়ির লোক থেকে শুরু করে ভবঘুরে, এলাকার মস্তান, সমাজবিরোধী, নেশাখোর— সকলকেই আশ্রয় দেয় হাসপাতাল চত্বর। মদ-জুয়া সবই চলে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এত বড় হাসপাতাল, এত রোগীর পরিজনেরা রাতে হাসপাতাল চত্বরে থাকেন। কে কোথা দিয়ে ঢুকছে, কে বাড়ির লোক আর কে দুষ্কৃতী, বোঝাই যায় না। নজর রাখতে অনেক পুলিশ দরকার, শুধু আমাদের নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে এ কাজ সম্ভব না।’’
শুক্রবারের রাতের ঘটনায় আহত দুই যুবকের নাম প্রদীপ্ত দে এবং সুদীপ সেন। তাঁরা পূর্ত দফতরের ঠিকা শ্রমিক। গত তিন বছর ধরে ওই হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার বহনের কাজ করেন। লালবাজার জানিয়েছে, শনিবার রাত পর্যন্ত দুই দুষ্কৃতী গ্রেফতার না হলেও তারা স্থানীয় বলেই অনুমান। দুই তরুণী এবং জখম যুবকদের সাহায্য নিয়ে দুষ্কৃতীদের স্কেচ আঁকানো হচ্ছে। ঘটনাস্থলের কাছে সিসিটিভি না থাকাই হাসপাতালের গেটে থাকা সিসিটিভি-র ছবি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অবাঞ্ছিত বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে শনিবার রাত থেকেই হাসপাতাল চত্বরে অভিযান চলছে।
হাসপাতালে শুয়ে শনিবার আহত প্রদীপ্ত বলেন, ‘‘৬ নম্বর গেটের দিক থেকে হস্টেলের দিকে হেঁটে আসছিলেন দুই তরুণী। আর তাঁদের পিছন-পিছন দু’টি ছেলে আসছিল। কাছাকাছি আসতেই তরুণীদের এক জন এগিয়ে এসে ভয়ার্ত গলায় সাহায্য চেয়ে জানান, ছেলে দু’টি অনেক ক্ষণ ধরে তাঁদের উত্ত্যক্ত করছে। আমরা ছেলে দু’টিকে চলে যেতে বলি। কিন্তু ওরা শোনেনি। উল্টে আমাদের হুমকি দিয়ে বলে, ওরা এলাকার ছেলে, আমরা বাইরের। তাই আমরা যেন ওদের ব্যাপারে মাথা না গলাই। ওদের হুমকিতে আমরা ভয় না পাওয়ায় ওরা মারামারি শুরু করে।’’
প্রদীপ্ত ও সুদীপ জানান, বচসা এবং মারমারির মধ্যেই দুষ্কৃতীদের এক জন ছুরি বার করে সুদীপের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। প্রদীপ্তের দাবি, সুদীপের পেটে দুষ্কৃতীরা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে দেখে তিনি রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ভাঙা পাইপের টুকরো নিয়ে ওদের দিকে দৌড়ে যান। তখনই প্রথমে তাঁর হাতে এবং পরে পেটে ছুরি মারে দুষ্কৃতীরা। প্রদীপ্তের কথায়, ‘‘আমার চেহারা বেশ শক্তপোক্ত। ওই অবস্থাতেও ওদের ধাওয়া করি। কিন্তু ওরা পালিয়ে গেল। তরুণী দু’জন পুলিশের খোঁজে খুব দৌড়োদৌড়ি করছিলেন। পাশেই জনা পঞ্চাশ লোক দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। কেউ এগিয়ে এল না। দুই তরুণী সবাইকে বলেছিলেন, ‘আপনারা কি মানুষ! একটু সাহায্য করছেন না ছেলে দু’টিকে!’ তার পরেও কেউ না এগিয়ে আসায় আমাদের হাত ধরে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলেন ওঁরা। সকাল পর্যন্ত টানা আমাদের পাশেই ছিলেন দু’জনে।’’ ওই দুই তরুণী অবশ্য সংবাদমাধ্যমের সামনে কিছু বলতে চাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy