Advertisement
E-Paper

প্রয়োজনের পসরা সাজিয়ে হাজির ‘দয়ালু দেওয়াল’

এ-ও সম্ভব! তেহরান, আবুধাবি, আমস্টারডাম, জয়পুরের পথে কলকাতাও? লেকটাউনের সাদামাটা দেওয়ালটা জানান দিচ্ছে— বিশ্বাস না হলে এসে নিজের চোখে দেখে যান।

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০২:২৬
লেকটাউনের সেই দেওয়াল। — নিজস্ব চিত্র

লেকটাউনের সেই দেওয়াল। — নিজস্ব চিত্র

এ-ও সম্ভব!

তেহরান, আবুধাবি, আমস্টারডাম, জয়পুরের পথে কলকাতাও?

লেকটাউনের সাদামাটা দেওয়ালটা জানান দিচ্ছে— বিশ্বাস না হলে এসে নিজের চোখে দেখে যান। দেখার মতোই বিষয় বটে। ব্যস্ত কলকাতা থমকে দাঁড়াচ্ছে রাস্তার পাশে আটপৌরে দেওয়ালটার সামনে। সেখানে সাদা ফ্লেক্সের গায়ে লাল কালিতে লেখা—‘ওয়াল অব কাইন্ডনেস’।

ওই তিনটে শব্দেই ম্যাজিক দেখছে মহানগর। কেউ এসে ঝুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন পুরনো শার্ট, ট্রাউজার্স, সোয়েটার। কেউ এসে রেখে যাচ্ছেন থালা-বাটি-গেলাস। সেগুলো যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা একে একে এসে নিয়ে যাচ্ছেন। ঢাউস মঞ্চে দাদাদের দাপাদাপি নেই। মাইকে রাজনীতির কচকচানি নেই। এই বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে নীরবে। কোনও প্রচার ছাড়াই।

দান-ধ্যান-দয়া-দাক্ষিণ্যের মধ্যে আনুগত্য শব্দটার যে নিবিড় যোগ, বলতে গেলে সেই চেনা ছকটাই ভেঙে দিয়েছেন লেকটাউনের মাঝবয়সী দম্পতি রাজেশকুমার গোয়েন্‌কা ও নীলম গোয়েন্‌কা। পাশে পেয়েছেন এলাকার আরও কয়েক জনকে।

নিজেদের উদ্যোগে বাঁশ, ত্রিপল দিয়ে তিন দিক ঘেরা এক টুকরো দেওয়াল তৈরি করেছেন ওঁরা। সেখানে টাঙানো সারি সারি পোশাক। মেঝেতে গেরস্থালির হাজারো টুকিটাকি। দেওয়ালে লেখা— ‘অপ্রয়োজনীয় জামাকাপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র এখানে রাখুন। যার যেটা প্রয়োজন, সেটা নিয়ে যান’। দেওয়ালের নাম—‘উদারতা দেওয়াল’। এটাই নাম নাকি? ‘‘পাশে দাঁড়ানোই যখন লক্ষ্য, তখন নামে কী আসে যায়?’’ হাসছেন গোয়েন্‌কা দম্পতি।

পথ চলা শুরু হয়েছে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। মাসখানেকের মধ্যে বিপুল সাড়া। পোশাক, গেরস্থালির জিনিসের ভিড়ে এখন ঠাঁই নেই রব। শুরুতে যাঁরা দূর থেকে দেখতেন, সেই স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে এসেছেন দেওয়ালের পাশে।

লেকটাউনে জয়া সিনেমা হল থেকে যশোর রোডের দিকে কিছুটা এগোলেই বাঁ দিকে একটি আবাসন। সামনে রাস্তার ধারে সেই ‘দয়ালু দেওয়াল’। লাগোয়া আবাসনেই থাকেন গোয়েন্‌কা দম্পতি। রাজেশের পোশাক আমদানি-রফতানির ব্যবসা। নীলম ব্যস্ত সমাজসেবায়।

হঠাৎ এমন খেয়াল কেন? খেয়াল নয়, কলকাতায় এমন ব্যবস্থা চোখে না পড়লেও বিদেশে বেশ পুরনো। তেহরান, আবুধাবি, আমস্টারডামে এই ব্যবস্থা রীতিমতো সফল। বেঙ্গালুরু-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাড়ি থেকে পুরনো জামাকাপড় নিয়ে গিয়ে বিলি করে। কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থা আবার কর্মীদের কাছ থেকে পোশাক সংগ্রহ করে বিভিন্ন বস্তিতে বিলি করে। জয়পুরে একটি সংস্থা এমন ব্যবস্থা চালু করেছে। সেখানে পুরনো কাপড়জামা দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে যান কেউ কেউ। প্রয়োজনমতো তা নিয়ে যান অনেকেই।

নীলম ও রাজেশ জানান, সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি জানার পরে উৎসাহিত হন। নিজেদের আবাসনের সামনেই তাঁরা সেই দেওয়াল তুলে ফেলেন। বিষয়টি জেনে এগিয়ে আসেন আবাসনের অন্য বাসিন্দারাও। দেওয়ালে প্রথম পোশাক ঝুলিয়ে দেন তাঁরাই। তার পরে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। আবাসনের নিরাপত্তারক্ষী মাখনলাল দে, কেষ্ট দাসেরা বলছেন, ‘‘প্রথম দিকে অনেকেই দূর থেকে দেখতেন। কিন্তু কিছু নিতে সাহস পেতেন না। আমরাই তাঁদের উৎসাহ দিই। বিষয়টা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এখন সব কিছুই চলছে মসৃণ ভাবে।’’ বুধবার বিকেলে দমদম পার্ক খালপাড় থেকে এসেছিলেন বছর ষাটের বুধিয়া যাদব। একটা সোয়েটার নিয়ে বললেন, ‘‘বড্ড উপকার হল। না হলে শীতটা কাঁপতে কাঁপতে কাটাতে হতো।’’

কলকাতায় এমন ব্যবস্থা চালু হয়েছে শুনে উচ্ছ্বসিত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আমার তো শুনে খুবই ভাল লাগছে। বস্ত্র-সহ নানা জিনিসপত্র বিলি করার জন্য রাজনীতিবিদদের কেন ডাকা হয়, আমার তা মাথায় ঢোকে না!’’ বছরভর বস্ত্র বিতরণ-সহ নানা ধরনের কর্মসূচির সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পাল। তিনি কিন্তু সন্দিহান, ‘‘প্রচুর পুরনো জামাকাপড় তুলে নিয়ে গিয়ে কেউ যদি আবার বাসনপত্র কিনে বসেন?’’

যা শুনে হাসছেন রাজেশ-নীলমের গাড়ির চালক কিষাণপ্রসাদ রজক ও সন্তোষ মুখিয়া। বলছেন— ‘‘চুরি? এ শহরে এখনও জান আছে মশাই। এত দিনে একটা আলপিনও খোয়া যায়নি।’’

এ কলকাতায় যে এমন আর একটা কলকাতাও আছে, কে জানত!

Un-useable cloths distribution campaign initiative
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy