পাশাপাশি নয়, সামনে-পিছনে। একসঙ্গে এগোনো নয়, পাশের জনকে ধাক্কা মেরে পিছনে ফেলে নিজে এগোনো। এটাই কি এখন সমাজের চেনা ছবি? সল্টলেকে বৃহস্পতিবার সকালের ঘটনা অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা উস্কে দিয়েছে।
রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলো-অভিনয়, সবেতেই সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাব ক্রমশ প্রকট হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তারই প্রতিফলন সর্বত্র। বদলে যাচ্ছে মানুষের প্রকাশভঙ্গি। সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, ইদানীং সহিষ্ণুতা ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকেছে। মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ক্রমশ অতীত হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা হয়তো তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘হিংস্রতাই এখন যোগাযোগের মূল মাধ্যম। এমনকী, প্রেমের ক্ষেত্রেও। সেই কারণেই প্রেমেরও ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলাৎকার বা অ্যাসিড ছোড়া। পাশের দোকানের ক্রেতাদের দিকে যাঁরা গরম তেল ছুড়ে মারতে দ্বিধা করেন না, তাঁরাও তো আসলে ওই হিংস্রতার ভাষাকেই আপন করে নিয়েছেন।’’
কিন্তু কেন এমন সহিষ্ণুতার অভাব? সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, এর পিছনে অনেকটাই রয়েছে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা। ‘আমি যা-ই করি না কেন, পার পেয়ে যাব’ এই বিশ্বাসটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু মানুষ দেখছেন যে তাঁরই পাশে কেউ অন্যায় করেও দিব্যি শাস্তি না পেয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তখন তাঁরও মনে হচ্ছে, তা হলে আমি কেন যথেচ্ছাচার করব না? এ ব্যাপারে প্রশাসনিক স্তরে কঠোর মনোভাবই এই প্রবণতা থেকে মানুষকে বার করে আনতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
তবে এরই পাশাপাশি আরও একটি দিকে আঙুল তুলেছেন মনোবিদরা। তাঁদের মতে, এই প্রবণতা বহু ক্ষেত্রেই মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা নিরাপত্তাহীনতাকেই বার করে আনে।
মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদারের মতে, ‘‘নিরাপত্তহীনতা থেকেই আসে আগ্রাসী মনোভাব। সাধারণ ভাবে মানুষ সেটা ঢাকা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে সেটা আচমকাই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মানুষ।’’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সল্টলেকের ওই ঘটনায় অন্য দোকানদারের প্রতি রাগ, আক্রোশ তৈরি হচ্ছিল চায়ের দোকানের কর্মীদের মনে। কারণ তাঁদের দোকানের বিক্রি কমতে শুরু করেছিল। এর জেরে তৈরি হওয়া রাগেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অন্য ক্রেতাদের গায়ে ফুটন্ত তেল ছুড়ে দেওয়ার ঘটনায়। ‘যারা আমার দোকানের খাবার খাবে না, তাদের আমার পাশের দোকানের খাবারও খেতে দেব না’-এটাই মূল লক্ষ্য।
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল জানান, চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে ‘ইমপালস্ কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার’। তিনি বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে শুধু টাকা নয়, পরিচিতির দিকটিও যেহেতু খানিক ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তাই নিজেদের রাগ-আবেগ নিয়ন্ত্রণে রা তে পারেননি ওঁরা। এই সব ক্ষেত্রে কী ভাবে নিজেদের আরও উন্নতি ঘটিয়ে জিতে যাওয়া যায় সেই চিন্তা মাথায় আসে না কারও। কী ভাবে অন্যকে ঠেকিয়ে রেখে নিজে এগোনো যায় সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তার পরিণতি কী হতে পারে, তা-ও মাথায় আসে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy