Advertisement
১১ মে ২০২৪

প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাইক নিয়ে মারণ খেলা

দিল্লির সিগনেচার ব্রিজে নভেম্বরের এক বিকেল। নিজস্বী তোলার হিড়িকের জন্য তত দিনে ওই সেতু খবরের শিরোনামে। মোটরবাইকের পিছনের আসনে বসা এক যুবক দেদার নিজস্বী তুলছেন। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় চালকের আসনে বসা যুবকও হ্যান্ডেল ছেড়ে মোবাইল হাতে সিটের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

কেরামতি: সল্টলেকের রাস্তায় বাইক নিয়ে কসরত। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

কেরামতি: সল্টলেকের রাস্তায় বাইক নিয়ে কসরত। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৫৭
Share: Save:

গত অগস্টের উত্তরাখণ্ড। বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে নদী। রামনগরের কাছে সেই উত্তাল নদীর উপরে সেতু দিয়ে মোটরবাইকে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। সেতুর মাঝামাঝি এসে দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে বাইকের সিটে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। আশপাশ থেকে প্রবল সিটির আওয়াজ, হাততালির ঝ়়ড়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অবশ্য সব ঝাপসা। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সেতু ভেঙে মোটরবাইক-সহ তলিয়ে যান ওই ব্যক্তি। ‘স্টান্ট ম্যানিয়া’র সেই বিপর্যয়ের ভিডিয়ো দেখে চমকে উঠেছিলেন অনেকেই।

দিল্লির সিগনেচার ব্রিজে নভেম্বরের এক বিকেল। নিজস্বী তোলার হিড়িকের জন্য তত দিনে ওই সেতু খবরের শিরোনামে। মোটরবাইকের পিছনের আসনে বসা এক যুবক দেদার নিজস্বী তুলছেন। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় চালকের আসনে বসা যুবকও হ্যান্ডেল ছেড়ে মোবাইল হাতে সিটের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দ্রুত গতিতে থাকা মোটরবাইক কিছুটা এগোনোর পরে সামনের ডিভাইডারে প্রবল জোরে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। ঘটনাস্থলে পড়েই মাথা থেঁতলে যায় ওই দুই যুবকের।

গত অগস্টে কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউনে স্টান্টবাজি রুখতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। হাত-পা ছড়িয়ে বিপজ্জনক ভাবে তাঁদের বাইক-কেরামতি আটকানোর ‘অপরাধে’ ওই সিভিক ভলান্টিয়ারকে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন বাইক-আরোহীরা। পরে পুলিশের তা়ড়া খেয়ে মাঝ রাস্তায় সিভিক ভলান্টিয়ারকে ফেলে দিয়ে পালান তাঁরা।

পুলিশের একাংশের বক্তব্য, একের পর এক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার পরেও হুঁশ ফিরছে না তরুণ মোটরবাইক-আরোহীদের। কড়া পুলিশি নজরদারির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইকের কেরামতি দেখাচ্ছেন তাঁরা। প্রশিক্ষণহীন চালকেরা স্টান্টের নামে কোথাও বাইকের সামনের চাকা উপরে তুলে দিচ্ছেন, তো কোথাও আবার ঝড়ের গতিতে বাইক চালাতে চালাতেই হ্যান্ডেলে হাত রাখার বদলে পা রেখে সিটের উপরে সটান শুয়ে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই যার পরিণাম হচ্ছে মারাত্মক! মঙ্গলবার বড়দিনের রাতে যেমনটা হয়েছে হাওড়ার মন্দিরতলায়। মৃত্যু হয়েছে এক তরুণের। জখম তাঁর সঙ্গী।

রূপঙ্কর মান্না। নিজস্ব চিত্র

মোটরবাইক ‘র‌্যালি’র সঙ্গে যুক্ত লোকজন অবশ্য জানাচ্ছেন, যে তরুণ-তরুণীরা ভেল্কি দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন, তাঁদের কারওরই প্রশিক্ষণ নেই। তাঁদের মতে, পেশাদার স্টান্ট হয় নিয়ম মেনে, ঘেরা জায়গায়। কলকাতার এক স্টান্ট বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘হাওড়া স্টেডিয়ামে আমাদের প্রতিযোগিতা হয়। নানা সুরক্ষা-বিধি মেনে আমরা স্টান্ট করি। মোটরবাইকগুলিও তার জন্য আলাদা ভাবে প্রস্তুত রাখা হয়। বাইরে যাঁরা স্টান্ট করতে গিয়ে বিপদ ঘটাচ্ছেন, তাঁরা এ সব নিয়মের কিছুই মানেন না।’’ পেশাদারেরা এগুলি করার জন্য ‘পারফরম্যান্স’ পিছু ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান। আন্তর্জাতিক বাইক প্রস্তুতকারক সংস্থার উদ্যোগে হওয়া ওই প্রতিযোগিতায় পুরস্কারমূল্য থাকে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

উত্তর কলকাতার ‘বাইকার্স গ্রুপ’-এর তরফে রোহিত সিংহ জানান, সাধারণত ‘হুইলি’ (হঠাৎ গতির ঝ়ড় তুলতে গিয়ে মোটরবাইকের সামনের চাকা মাটি থেকে উপরে তুলে দেওয়া), ‘স্টপি’ (দ্রুত গতিতে থাকা বাইক হঠাৎ থামাতে ব্রেক কষার ফলে পিছনের চাকা উপরে উঠে যাওয়া), ‘ক্রাইস্ট’ (বাইক চালাতে চালাতে দু’হাত দু’পাশে প্রসারিত করে সিটে উঠে দাঁড়ানো), ‘৩৬০’ (এক জায়গায় স্ট্যান্ড বা পা নামিয়ে তার চার দিকে চক্রাকারে বাইক ঘোরানো) এবং ‘হ্যান্ডেল সার্কেল’ (হাতের বদলে পা দিয়ে হ্যান্ডেল নিয়ন্ত্রণ) করা হয়। এগুলির প্রত্যেকটিই অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর সঙ্গে প্রশিক্ষণহীন হাতে যুক্ত হয় আরও কিছু মারণ কেরামতি। প্রাক্তন বাইকার নীলাদ্রি বসু বলেন, ‘‘রাস্তায় নেমে যাঁরা এগুলো করেন, তাঁরা স্রেফ হুজুগে। আসল বাইকার নিয়মের বাইরে গিয়ে এ সব করেন না।’’

যদিও বাইকারদের এই যুক্তি মানতে পারছেন না অনেকেই। তাঁদের মতে, বিশ্বে বহু মারণ খেলা চলে। তবে প্রকাশ্যে তা করা নিষিদ্ধ। তার জন্য কড়া আইনও রয়েছে। যদিও এ দেশে স্টান্টবাজি আটকানোর আলাদা করে কোনও আইন নেই। সবই বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালানোর ধারায় ফেলে দেখা হয়। এ জন্যই বল্গাহীন স্টান্টবাজিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না বলে তাঁদের মত। পেশাদারদের দেখে নকল করতে গিয়েই ঘটছে বিপদ।

মনোরোগ চিকিৎসকেরা অবশ্য জানাচ্ছেন, এর সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি বিষয় যুক্ত হচ্ছে। বিদেশি ছবির ‘অ্যাকশন’ দৃশ্য প্রভাবিত করছে তরুণ-তরুণীদের। সেখানে নায়ককে হেলমেট ছাড়া বাইক নিয়ে কেরামতি করতে দেখে নিজেরাও সেই পথে হাঁটতে চাইছেন অল্পবয়সীরা। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বন্ধুদের চাপ! মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলেন, ‘‘বন্ধুরা করছে, তাই আমাকেও করতে হবে, এই মানসিকতা আরও বেপরোয়া করে তুলছে অল্পবয়সিদের। সেই সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের ধৈর্যের অভাব আর অল্পে নাম কেনার প্রবণতা যুক্ত হচ্ছে।’’ তাঁর মতে, কড়া আইন ছাড়া এ জিনিস বন্ধ করা যাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Training Death Bike Stunt
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE