Advertisement
১১ মে ২০২৪
এম আর বাঙুর

একটি ঘর ‘ফেলে যাওয়াদের’ আশ্রয়স্থল

ওয়ার্ডের বন্ধ দরজার সামনে রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকেন বছর ষাটেকের মালতিদেবী। লোক দেখলেই ডেকে বলেন, “আমার দুই ছেলেকে বলো, আমি এখানে আছি। ওঁরা যেন এসে আমায় বাড়ি নিয়ে যায়।” অসুস্থ মালতিদেবীকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিলেন ছেলেরা। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পরে তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাননি কেউ।

এমন ভাবেই থাকেন ওঁরা। ছবি: দেবাশিস রায়।

এমন ভাবেই থাকেন ওঁরা। ছবি: দেবাশিস রায়।

দেবাশিস দাস
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০১:০৮
Share: Save:

ওয়ার্ডের বন্ধ দরজার সামনে রোজ এসে দাঁড়িয়ে থাকেন বছর ষাটেকের মালতিদেবী। লোক দেখলেই ডেকে বলেন, “আমার দুই ছেলেকে বলো, আমি এখানে আছি। ওঁরা যেন এসে আমায় বাড়ি নিয়ে যায়।”

অসুস্থ মালতিদেবীকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিলেন ছেলেরা। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পরে তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাননি কেউ। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ভর্তি করার সময়ে হাসপাতালের খাতায় ঠিকানা লিখে গিয়েছিলেন মালতিদেবীর ছেলেরা। পরে তাঁরা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খোঁজ করে জানতে পারেন, তাঁদের দেওয়া ওই ঠিকানার কোনও অস্তিত্বই নেই। তাই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি মালতিদেবীর ছেলেদের। হাসপাতালের এক কর্মীর অভিযোগ, “ছেলেরা জানেন, মা এখানে।” তবুও ছেলেদের দোষ দেন না মালতিদেবী। বলেন, “হয়তো সময়ের অভাবে আসতে পারছে না ওরা। সময় পেলেই এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে।”

মালতিদেবীর মতোই টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতালে এ ভাবে দিন কাটাচ্ছেন ৩৬ জন। তাঁদের সকলেরই বাড়ির বদলে ঠিকানা এখন হাসপাতাল। কারণ, সুস্থ হওয়ার পরেও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি কেউ। বেশ কয়েক জন আছেন, যাঁদের বিভিন্ন সময়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গিয়েছে পুলিশ। কারও কারও পরিচয়ই জানা যায়নি। হাসপাতালের খাতায় এঁরা সকলেই ‘আন-নোন’ হিসেবে চিহ্নিত। এক সময়ে এঁদের সকলেরই সংসার-পরিজন ছিল। কিন্তু আজ তাঁরা কার্যত সব-হারা।

অনেকটা মালতিদেবীর মতোই অবস্থা মলিনা ঘোষের। বয়স সত্তরের উপরে। বাড়ি কালীঘাট এলাকায়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক স্বামীর মৃত্যুর পরে এক দিন বাড়িতে পড়ে গিয়ে দুই পায়ে চোট লাগে মলিনাদেবীর। সেই থেকে আর হাঁটতে পারেন না তিনি। নিঃসন্তান মলিনাদেবী ধর্মপুত্র মেনেছিলেন এক জনকে। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে দিয়ে যাওয়ার পরে আর এক দিনও খবর নিতে আসেনি আমার ধর্মছেলে।”

মলিনাদেবীর চেয়ে বয়সে বছর কুড়ি ছোট মাঝবয়সী ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়। বেথুন কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেছেন। বলেন, “বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। বাড়ি কাকুলিয়া এলাকায়। দু’বছর বয়সে বাবাকে হারাই। মায়ের মৃত্যুর পরে পুরো একা হয়ে যাই। বছর তিনেক আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হই। পুলিশ উদ্ধার করে এই হাসপাতালে নিয়ে আসে।” সেই থেকে বাঙুর হাসপাতালই ঠিকানা ফাল্গুনীদেবীর।

হাসপাতালের সহকারী সুপার সেমন্তী মুখাপাধ্যায়ের কথায়, “শারীরিক ভাবে এখন সুস্থ ফাল্গুনী। তবে এখানকার বদ্ধ পরিবেশে তার মানসিক অবসাদ ক্রমশ বাড়ছে। ওজন কমে যাচ্ছে। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে ওর জন্য আবেদন করেছি। কোনও সাড়া পাইনি।”

এর উল্টো ছবিটাও রয়েছে। হাসপাতালে থাকতে থাকতে অনেকে আবার ভুলেই গিয়েছেন বাড়ির কথা। তাঁরা দাবি করেন, কোথায় বাড়ি ছিল তা-ও তাঁদের মনে নেই। তাই হাসপাতালেই থাকতে চান তাঁরা। এঁদেরই এক জন মায়া সাহা। স্বামীর মৃত্যুর পরে অসুস্থ হওয়ায় ছেলে আর পুত্রবধূ যে হাসপাতালে দিয়ে গিয়েছিল তা এখনও ভোলেননি তিনি। বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতেই হাত জোড় করে ধরা গলায় বলেন, “আমি বাড়ি যাব না। কিছুতেই যাব না। বাড়ি কোথায় ছিল মনে নেই। আমার মতো অভাগীর এটাই স্বর্গ।”

মায়াদেবীর মতোই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই শোভা অধিকারী, শান্তনু মজুমদার, পরিমল রায়েরও। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেই এঁদের একটাই উত্তর, ‘মনে নেই। কোথায় ছিল জানি না।’ হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, “ওঁরা বাড়িতে এত অত্যাচার সহ্য করেছেন যে, আর ফিরতে চান না। তাই বাড়ির কথা জানতে চাইলে কিছুতেই ঠিকানা বলতে চান না। বলেন, ঠিকানা মনে নেই।” হাসাপাতালের সুপার সোমানাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “হাসপাতালে ওঁরা খেতে-পরতে পান। দরকারে ওষুধপত্র দেওয়া হয়। তাই এঁরা আর হাসপাতাল থেকে কোথাও যেতে চাইছেন না। আমরা ছাড়া ওঁদের তো আর কেউ নেই।”

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, এঁদের জন্য কোনও তহবিল নেই। সাধারণ রোগীদের খাবার থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে এঁদের খেতে দেওয়া হয়। হাসপাতালের কিছু কর্মী এঁদের জন্য বাড়ি থেকে পুরনো জামাকাপড় নিয়ে আসেন। তবে এই সব রোগীদের ওয়ার্ড, বেড নিয়মিত পরিষ্কার রাখার সমস্যাও রয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকে হেঁটে শৌচালয় পর্যন্ত যেতে পারেন না।

হাসপাতালের এক কর্তা জানিয়েছেন, এঁদের জন্য দিনে অন্তত দু’টো করে ‘ডায়াপার’ প্রয়োজন। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই ব্যবস্থাও করা যায় না। তবে এঁদের নিয়মিত চুল-নখ কাটানো হয়। সাবান দিয়ে স্নান করানো হয় বলে জানান তাঁরা।

এম আর বাঙুর হাসপাতালের রোগী কল্যাণ কমিটির চেয়ারম্যান এবং রাজ্যের আবাসন ও যুব কল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অবশ্য বলেন, “এঁদের নিয়মিত যত্নে রাখা হয়। পুজোর সময়ে নতুন পোশাক পরিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এঁরা যাতে আরও ভাল পরিষেবা পান, তার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debashis das m r bangur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE