Advertisement
E-Paper

কনের পিঁড়ির ভার বইতে ‘ভাই’ মিলবে ভাড়ায়

কনের ওজনটা একটু বেশির দিকে। তাঁকে পিঁড়িতে চড়িয়ে, সাত পাক ঘুরিয়ে এক্কেবারে সনাতনী কায়দায় বিয়ে দেওয়ার ঝক্কি তাই বড় কম নয়। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর থেকেই চিন্তাটা খচখচ করছিল বাড়ির লোকজনের মনে। ‘স্বাস্থ্যবতী’ কনের পিঁড়ি ধরার জন্য কাকে অনুরোধ করা যায়? আত্মীয়দের কেউ যদি আগ্রহ না দেখান? যদি মুখের উপরেই সটান না বলে দেন? বিরক্ত হন?

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৩৯
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

কনের ওজনটা একটু বেশির দিকে। তাঁকে পিঁড়িতে চড়িয়ে, সাত পাক ঘুরিয়ে এক্কেবারে সনাতনী কায়দায় বিয়ে দেওয়ার ঝক্কি তাই বড় কম নয়। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর থেকেই চিন্তাটা খচখচ করছিল বাড়ির লোকজনের মনে। ‘স্বাস্থ্যবতী’ কনের পিঁড়ি ধরার জন্য কাকে অনুরোধ করা যায়? আত্মীয়দের কেউ যদি আগ্রহ না দেখান? যদি মুখের উপরেই সটান না বলে দেন? বিরক্ত হন?

কনের ভাই, জামাইবাবু, পাড়াতুতো দাদাদের ঠেলাঠেলির আর দরকার নেই। মুশকিল-আসান হাজির। ‘অর্ডার’ করলেই এখন কলকাতার বিয়েবাড়িতে কনের পিঁড়ি ধরার লোক ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে! বৌ যতই মোটা হোন, তাঁরা টুক করে পিঁড়িতে তুলবেন আর ফটাফট সাতপাক ঘুরিয়ে দেবেন। ওই পিঁড়িতে বসে শুভদৃষ্টি-মালাবদলও সেরে নেওয়া যাবে। চার জন পিঁড়িবাহক মিলবে মাথাপিছু ৪০০-৬০০ টাকা দিলেই।

এই পিঁড়িবাহকদের কাছে ওজন কোনও ফ্যাক্টর নয়। দুই কুইন্টাল থেকে তিন কুইন্টাল চালের বস্তা হাতে তুলে সাত-আট পাক ঘুরিয়ে রীতিমতো পরখ করে লোক নিয়োগ করছে ‘ওয়েডিং প্ল্যানার’ সংস্থাগুলি। তাদের দাবি, এমন ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে যাতে পিঁড়ি এক বারও টলে যাবে না। ফলে নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের গ্যারান্টি থাকছে।

বিয়ের মরসুমে পিঁড়িবাহকদের চাহিদা দেখেই ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আট-ন’জন হাট্টাকাট্টা লোক বাছাই করে এনেছেন ‘চতুর্দোলা এজেন্সি’-র সুব্রত বিশ্বাস। অগ্রহায়ণ মাসেই কালিন্দি, বালিগঞ্জ এবং স্বভূমিতে তিনটি বিয়েবাড়িতে পিঁড়ি ধরার লোক দিয়েছেন। তিনি জানান, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের ১৪টি বুকিংয়ের মধ্যে চারটি বাড়িতে পিঁড়ি ধরার লোক বায়না করেছে। ঝাড়খণ্ডের তিলেডি, মহেশিয়াদিঘি, খাপড়াতোল, মির্জাগঞ্জ, শাখোবাশদির মতো কিছু গ্রাম থেকে পিঁড়িবাহক বেছে এনেছেন। কারণ ওই অঞ্চলের লোকেরা খুব তাগড়াই চেহারার। অনায়াসে ওজন তোলেন।

১৪ ডিসেম্বর স্বভূমিতে খড়্গপুরের স্কুলশিক্ষিকা ছন্দা চক্রবর্তীর মেয়ের বিয়েতে পিঁড়ি ধরতে ভাড়া করা হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের দারাসরণ গ্রামের টুপালি দাস, তুলসী, খেমচাঁদ দাস আর বিদেশি ঠাকুরকে। বাহকদের ‘পারফরম্যান্স’-এ উচ্ছ্বসিত ছন্দাদেবী বললেন, “আমার লোকবল কম ছিল। কিন্তু বিয়ের নিয়মকানুনে কোনও রকম আপস করতে চাইনি। তুলসী, খেমচাঁদরা দুর্দান্ত উতরে দিয়েছেন।”

‘শ্রী বেঙ্গলি ওয়েডিং প্ল্যানার’ সংস্থার পাপিয়া দাস, ‘শুভ মুহরত’ সংস্থার পৃথ্বীশ বিশ্বাস, ‘ওয়েডিং এক্সট্রাঅর্ডিনারি’র সইদুল হকদের মতো অনেকেই একটা বিষয়ে একমত। মানুষ ক্রমশ আত্মীয়হীন হচ্ছে, পারিবারিক উৎসব-অনুষ্ঠানে লোকবল কম পড়ছে। সম্পর্কের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে বলে অনেকেই বিয়ের কাজের জন্য আত্মীয়দের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে বা খোশামদ করতে চাইছেন না। আত্মীয়েরাও নেমন্তন্ন খেতে এসে ঘামে জবজবে হয়ে, হাঁফিয়ে পিঁড়ি ধরাটা এড়াতে চাইছেন। ওয়েডিং প্ল্যানারেরা এমন সুযোগ ছাড়বেন কেন? তাই পিঁড়ি ধরার পাশাপাশি তারা বরণ-কুলো সাজানো, স্ত্রী আচার, বাসর জাগা, কড়ি খেলা, বরযাত্রীর খাতির যত্ন করার লোকও ভাড়ায় দিচ্ছেন। সুব্রতবাবু জানালেন, গত বছর নভেম্বরে সালকিয়ার একটি বিয়েবাড়িতে পাত্রীর মা লাখখানেক টাকায় চার দিনের জন্য আত্মীয় ভাড়া নিয়েছিলেন! ভাড়ার পাত্রপাত্রীরা কেউ পাত্রীর মাসি কেউ পিসে, কেউ মামী, কেউ জ্যাঠার ভূমিকা নিয়েছিলেন।

সইদুল হক আবার জানালেন, অনেক গুজরাতি বা মারওয়ারি পরিবার এখন বাঙালি থিম-এ বিয়ে করতে চান। সেখানেও তাঁরা পাত্রীর পিঁড়ি ধরার জন্য লোক ভাড়া দেন। চার জন লোকের ভাড়া হাজার টাকা। পাপিয়া দাস জানান, তাঁরা পিঁড়িবাহকের সঙ্গে বিশেষ সাইজের পিঁড়ির অফার দেন। তাতে কনে বহনে সুবিধা হয়। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে তাঁদের কিছু প্রাক শর্তও থাকে। যেমন, সাত বারের বেশি কনেকে ঘোরানোর জন্য চাপ দেওয়া যাবে না এবং যখন ঘোরানো হবে তখন অন্য কেউ এসে পিঁড়িতে হাত লাগাবেন না বা ধাক্কাধাক্কি করবেন না। তাতেই লোকে রাজি হয়ে যাচ্ছে।

তবে এ সব শুনে বিষণ্ণ লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার। বললেন “আত্মীয়েরা এখন ভীষণ বিচ্ছিন্ন। তাঁরা অতিথির মতো বিয়েবাড়িতে গিয়ে সেজেগুজে চুপ করে বসে থাকেন, উপহার দিয়ে, খেয়েদেয়ে চলে যান। কেউ কাজকর্মে হইহই করে যোগ দিতে চান না। এই পরিস্থিতিতে বিয়ে আচারের বাণিজ্যকরণ হতে বাধ্য।” একই মত সমাজবিদ রুচিরা ঘোষের। তিনি বলেন, “একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। এত দিন অন্তত বিয়েবাড়ি গিয়ে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে মানুষ ছিঁড়ে যাওয়া পারিবারিক বন্ধনের সুতো গাঁথার চেষ্টা করত। এখন সেই তাগিদ নেই।” লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “আমাদের অল্পবয়সে বিয়েবাড়িতে কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশনে বা হাসিঠাট্টা করতে করতে পিঁড়ি ধরতে ছেলেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ত। এখন সব বদলে যাচ্ছে।”

parijat bandyopadhyay wedding planner
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy