Advertisement
E-Paper

বিজয়াতেই শিল্পী ধরার ময়দানি টক্কর

দশমীর সাতসকালেই দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী পুজো কমিটির কর্তাটি ফোনে ধরলেন এক শিল্পীকে। বললেন, ‘‘আগামী বছর আমাদের পুজোর দায়িত্ব নাও। টাকার জন্য ভেবো না।’’ বিসর্জনের পালা ফুরোতে না-ফুরোতেই এক ফোনে বরাত পেয়ে গেলেন নতুন শিল্পী। শিল্পীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উৎসবের শেষ দিন পর্যন্তও ধৈর্য ধরেননি অনেকে। যেমন শিল্পী বদলানোর সিদ্ধান্ত পুজো শুরুর আগেই নিয়ে ফেলেছিলেন শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতা।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৫ ০২:০০
বিসর্জনের আগে ধুনুচি নাচ। শুক্রবার বেলুড়ে সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

বিসর্জনের আগে ধুনুচি নাচ। শুক্রবার বেলুড়ে সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

দশমীর সাতসকালেই দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী পুজো কমিটির কর্তাটি ফোনে ধরলেন এক শিল্পীকে। বললেন, ‘‘আগামী বছর আমাদের পুজোর দায়িত্ব নাও। টাকার জন্য ভেবো না।’’ বিসর্জনের পালা ফুরোতে না-ফুরোতেই এক ফোনে বরাত পেয়ে গেলেন নতুন শিল্পী।
শিল্পীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উৎসবের শেষ দিন পর্যন্তও ধৈর্য ধরেননি অনেকে। যেমন শিল্পী বদলানোর সিদ্ধান্ত পুজো শুরুর আগেই নিয়ে ফেলেছিলেন শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতা। তাই বিজয়া দশমীতেই নতুন শিল্পীকে বায়না করে ফেলেছেন তিনিও।
সকলেই পরিবর্তনের দিকে, এমন ভেবে নেওয়ার কারণ অবশ্য নেই। এ বারের শিল্পীকে রেখেও দিচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা। এবং সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দশমী পর্যন্তও অপেক্ষা করেননি তাঁরা। যেমন দক্ষিণেরই একটি পুজোয় নতুন এক মহিলা শিল্পীর কাজ এ বার প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাই নবমীর রাতেই ওই শিল্পীকে পরের বারের জন্য ‘বুক’ করে ফেলেছেন উদ্যোক্তারা।
এ বার পুজোর শুরুতেই শিল্পী নিয়ে ফাঁপরে পড়ে গিয়েছিল উত্তর কলকাতার একটি ক্লাব। শেষ পর্যন্ত এক তরুণ শিল্পীকে ডেকে আনা হয়। সেই নবীন শিল্পী ৮০ দিনের মধ্যে পুজোর কাজ তুলে দিয়েছেন এবং প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। তাই সেই সঙ্কটমোচন শিল্পীকে আগামী বছরেও রেখে দেওয়ার জন্য তোড়জো়ড় শুরু করে দিয়েছেন ওই ক্লাবের কর্তারা।
শহরের বেশির ভাগ বারোয়ারি পুজোর মণ্ডপে প্রতিমা রয়ে গিয়েছে শুক্রবারেও। কিন্তু পুজো পর্ব মিটতেই আগামী বছরের জন্য ছক কষতে শুরু করে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। কেউ ইতিমধ্যেই নতুন শিল্পীকে বায়না করে ফেলেছেন। কেউ রেখে দিচ্ছেন পুরনো শিল্পীকেই। ভিড়ের চাপ কমতে না-কমতে শুরু হয়ে গিয়েছে পরের বারের থিম নিয়ে আলোচনাও। শিল্পী টানা এবং থিমে অভিনবত্ব আনার সেই পরিকল্পনার পিছনে বয়ে যাচ্ছে অন্যদের টক্কর দেওয়ার চোরাস্রোত।

ফুটবল-ক্রিকেট ময়দানের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে পুজো ময়দানের মিল প্রচুর। লিগ শেষ হতে না-হতেই খেলার ক্লাবগুলোয় খেলোয়াড় গ্রহণ-বর্জনের পালা শুরু হয়ে যায়। পুজো ময়দানের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, মহোৎসবের প্রতিযোগিতাতেও এমনটাই রীতি। গড়ের মাঠে যেমন খেলোয়াড় নিয়ে টানাপড়েন চলে ক্লাবে-ক্লাবে, শিল্পী নিয়েও পুজো-কর্তাদের লড়াই সেয়ানে-সেয়ানে। শহরের পুজোর সঙ্গে যুক্ত এক প্রবীণের কথায়, ‘‘এক সময় তো খেলোয়াড় হাইজ্যাক করার মতো শিল্পীও হাইজ্যাক করা হতো!’’

এখন সরাসরি সেই ‘হাইজ্যাক’ বা ছিনতাইয়ের প্রথা তেমন নেই। তবে এমন উদাহরণও আছে যে, এক শিল্পীকে দিয়ে কাজ করানোর ব্যানার লাগানোর পরে পুজো কমিটির কর্তাব্যক্তিরা জানতে পেরেছেন, ওই শিল্পী তাঁদের কাজ করবেন না। অর্থাৎ আইপিএল বা আইএসএলের মতো নিলাম না-হোক, তলে তলে শিল্পী কব্জা করার খেল্‌ চলেই। শিল্পীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার ভিত্তিতে হয়তো পরের বছরের আকর্ষণের প্রচার চালানো হচ্ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তি না-হওয়ায় সেই শিল্পীই চলে গিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বীর শিবিরে। এমন অঘটন এড়াতেই দেরি না-করে দশমীতেই আসছে বারের জন্য শিল্পীকে বরাত দেওয়ার কাজে নেমে পড়েছে পুজো কমিটিগুলি।

দলবদলের এমন ময়দানি চোরাস্রোতই উৎসব শেষ হতে না-হতেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরবর্তী পুজোর জন্য রীতিমতো যুযুধান করে তোলে। হাতিবাগান এলাকার একটি পুজো কমিটি দক্ষিণ কলকাতার এক প্রভাবশালী কাউন্সিলরের পুজোয় কাজ করা শিল্পীকে আগামী বছর নিজেদের শিবিরে নিয়ে আসার জন্য সমানে লড়ে চলেছে। হাতিবাগানের পুজোয় কাজ করা এক শিল্পীর সঙ্গে কথা চলছে দমদমের এক পুজোর। এ বার নামী-দামি সংস্থার পুরস্কার জেতা এক শিল্পীকে কে পাবেন, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। পুজো ময়দানের খবর, দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লাবে তাঁর কাজ প্রশংসা কুড়োলেও পরের বছর তাঁকে ওই পুজোয় না-ও দেখা যেতে পারে!

শুক্রবার ভাসানের ব্যস্ততা না-থাকায় কোনও কোনও কমিটির কর্তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে তাঁদের শক্তির বহর যাচাই করেছেন বলেও শোনা গেল। ওই কর্তারা মুখে অবশ্য বলেছেন, অবসর পেয়ে পরিবার নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের লোকজন বলেন, ‘‘ওঁরা আসলে পরের বছরের রণকৌশল ঠিক করার আগে আমাদের কাজ দেখে নিতে চাইছেন।’’

নিলাম না-হোক, দলবদলের খেলায় নেপথ্যের দড়ি টানাটানিতে কোন শিল্পীর কতটা দর উঠতে পারে, তা বোঝার জন্য দশমীর সন্ধ্যা আর রাতের দর্শক-খতিয়ানও নিচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা। কারণ, মহরমের জন্য শুক্রবার এবং আজ, শনিবার প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ। তাই সন্ধ্যা হতেই লোকজন ভিড় করেছেন বিভিন্ন মণ্ডপে। দশমীর সন্ধ্যায় লোকজন ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন উত্তর কলকাতার এক পুজো কমিটির সদস্যেরা। ভিড় সামলাতে তড়িঘড়ি পাঠানো হয় অল্পবয়সি কিছু স্বেচ্ছাসেবককে। তাঁদেরই এক জন স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, আজ একটু জিরোনো যাবে। তা-ও দেখছি কপালে নেই!’’

আবার এসো...। শুক্রবার জলপাইগুড়িতে। ছবি: সন্দীপ পাল

এ বারের পুজোয় রাস্তায় জনজোয়ার নেমেছিল চতুর্থী থেকেই। মণ্ডপের ভিতরের পরিস্থিতিটাকেও ঘোরালো করেছিল ছবি তোলার হুজুগ। কেউ তুলছিলেন ‘সেলফি’ বা নিজস্বী। কেউ প্রতিমার ছবি, মণ্ডপের কারুকাজ ক্যামেরাবন্দি করছিলেন। ছবি তোলার হিড়িক সামলাতে নাকাল হয়েছেন পুজো কমিটির লোকজন।

এ দিন অবশ্য ভিড়ের দাপট তুলনায় কম থাকায় মণ্ডপের ভিতরে অনেকটাই সময় পেয়ে গিয়েছেন ‘চিত্রগ্রাহকেরা’। বেহালার একটি মণ্ডপে নিশ্চিন্তে নানা কোণ থেকে প্রতিমার ছবি তুলছিলেন বছর কুড়ির এক তরুণী। শেষে রীতিমতো তাড়া লাগালেন তাঁর সঙ্গে থাকা মহিলা। দক্ষিণ কলকাতার এক মণ্ডপে আবার প্রতিমার সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছিলেন এক তরুণ। বললেন, ‘‘আগের দিন কয়েক জন বন্ধু এই মণ্ডপে ভিড়ের চোটে পকেট থেকে ক্যামেরাই বার করতে পারেনি।’’ উত্তরের একটি মণ্ডপে প্রতিমার ছবি মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করছিলেন দীপা মিত্র। বললেন, ‘‘আমার এক বন্ধু আছে পুণেতে। এ বছর ও আসতে পারেনি। তাই ভাল ভাল ছবি তুলে পাঠালাম।’’ অষ্টমী-নবমীর ভিড়ে এই সুযোগ পাননি ওই তরুণী। এ দিন ভিড় কম থাকায় বাধা দেয়নি পুজো কমিটিগুলিও। পুজোর ক’দিন ছবি তোলা আটকাতে ব্যস্ত থাকা এক পুজো-কর্তা দশমীর সন্ধ্যায় বললেন, ‘‘উৎসব তো শেষ। ভাঙা হাটে না-হয় একটু ছবিই তুলল!’’

abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy