Advertisement
২৪ মে ২০২৪

বিয়ের কার্ডের সূত্র ধরে হাতুড়ি হত্যার কিনারা

গোলাপি রঙের একটা বিয়ের আমন্ত্রণপত্র। পড়ে রয়েছে টেলিভিশন সেটের উপরে। খামের উপরে ইংরেজিতে লেখা ‘পুষ্পা সিংহ।’ একবালপুরের ফ্ল্যাটে পাওয়া ওই চিঠিরই সূত্র ধরে পুষ্পাদেবী ও তাঁর দুই মেয়ের (প্রদীপ্তি ও আরাধনা) খুনিদের কাছে পৌঁছানো গিয়েছে বলে দাবি করছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের বক্তব্য, ঘটনার মূল চক্রী তথা অভিযুক্ত মহম্মদ সিকন্দরের নাম হয়তো তদন্তে পরে উঠত।

ধৃত সিকন্দর।

ধৃত সিকন্দর।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

গোলাপি রঙের একটা বিয়ের আমন্ত্রণপত্র। পড়ে রয়েছে টেলিভিশন সেটের উপরে। খামের উপরে ইংরেজিতে লেখা ‘পুষ্পা সিংহ।’

একবালপুরের ফ্ল্যাটে পাওয়া ওই চিঠিরই সূত্র ধরে পুষ্পাদেবী ও তাঁর দুই মেয়ের (প্রদীপ্তি ও আরাধনা) খুনিদের কাছে পৌঁছানো গিয়েছে বলে দাবি করছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের বক্তব্য, ঘটনার মূল চক্রী তথা অভিযুক্ত মহম্মদ সিকন্দরের নাম হয়তো তদন্তে পরে উঠত। কিন্তু তিন জনকে মেরে দোকানে পুঁতে রাখার পরেও ঘাতকেরা যে ভাবে স্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছিল, তাতে এই সূত্রটুকু না-থাকলে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রহস্যের কিনারা করা হয়তো সম্ভব হত না।

রবিবার একবালপুরে সিকন্দরেরই মনিহারি দোকানের মেঝে খুঁড়ে দু’সপ্তাহ নিখোঁজ থাকা মা ও দুই মেয়ের পচা-গলা দেহ উদ্ধার হয়। ধৃত সিকন্দর ও তার ভাইপো মহম্মদ আমিনকে সোমবার আলিপুর কোর্টে তোলা হলে তাদের ১৪ দিন পুলিশি হেফাজত হয়। ধৃত দুই নাবালককে জুভেনাইল আদালতে পেশ করা হলে বিচারক তাদের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি হোমে রাখতে বলেছেন। দোষীদের শাস্তির দাবিতে আদালত ও থানার সামনে জনতা বিক্ষোভ দেখায়, একবালপুরে পথ অবরোধও হয়।

কিন্তু একটা বিয়ের কার্ড কী ভাবে রহস্যভেদের সূত্র দিল?

পুলিশ জানায়, মা ও মেয়েদের অপহরণের অভিযোগ পেয়ে গত ৩১ মার্চ বিকেলে পুলিশ তাঁদের চারতলার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ঢুকে কার্ডটি হাতে পায়। দেখা যায়, তার মারফত একবালপুরেরই ৭০ নম্বর সুধীর বসু রোডের বাসিন্দা মহম্মদ ইরফান নামে এক যুবকের বিয়ের অনুষ্ঠানে (৩ এপ্রিল) নিমন্ত্রণ করা হয় পুষ্পাকে। ইরফান সম্পর্কে সিকন্দরের ভাগ্নে। তদন্তকারীদের খটকা লাগে। তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, পাড়ায় পুষ্পা তেমন মেলামেশা করতেন না। তা হলে কে তাঁদের নিমন্ত্রণ করল?

উত্তর পেতে ইরফান আর তাঁর বাড়ির লোকজনকে জেরা করে জানা যায়, তাঁরা পুষ্পাকে চেনেনই না! তবে তাঁরা পুলিশকে জানান, পারিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী নিমন্ত্রিত আত্মীয়দের এক-এক জনকে চার-পাঁচটা কার্ড দেওয়া হয়েছিল, যাতে তাঁরা আবার তাঁদের পরিচিতদের নিমন্ত্রণ করতে পারেন। তেমনই কেউ হয়তো পুষ্পাকে নিমন্ত্রণ করে থাকবেন। এবং তখনই ইরফানের পরিচিত এক যুবক পুলিশকে বলেন, পুষ্পার সঙ্গে ইরফানের মামা মহম্মদ সিকন্দরের যোগাযোগ রয়েছে।

সিকন্দরের ফ্ল্যাট অবশ্য পুষ্পার বাড়িরই উপরতলায়। কিন্তু নিছক এক বাড়ির বাসিন্দাসুলভ পরিচিতির গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁদের মধ্যে যে পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করার মতো সম্পর্কও থাকতে পারে, সেটা তখন পুলিশের খেয়ালে আসে। সিকন্দরই কার্ডটি দিয়েছিল কি না জানতে তাকে থানায় ডাকা হয়। সিকন্দর বলে, সে ছিল কার্যত ওই বিধবা ও তাঁর দুই মেয়ের অভিভাবক। তাই ভাগ্নের বিয়েতে সে ওঁদের নিমন্ত্রণ করেছিল। সিকন্দর পুলিশকে এ-ও বলে, পুষ্পা তাকে ১৯ লক্ষ টাকায় ফ্ল্যাটের অধিকারস্বত্ব দিতে চেয়েছিলেন, সে পুষ্পাকে তিন দফায় ১৩ লক্ষ টাকা অগ্রিমও দিয়েছিল।

কিন্তু মেয়েদের নিয়ে মা গেলেন কোথায়? পুলিশের দাবি, এই প্রশ্নের উত্তরে সিকন্দর বলেছিল, ভিন রাজ্যের বাসিন্দা পাপ্পু নামের এক যুবকের সঙ্গে পুষ্পার ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্ক রয়েছে। সিকন্দরের এ হেন দাবির কোনও ভিত্তি তদন্তকারীরা এখনও খুঁজে পাননি। অন্য দিকে সিকন্দরের কথাবার্তায় তার উপরেই সন্দেহ বাড়তে থাকে। বোঝা যায়, পুষ্পার অবর্তমানে ফ্ল্যাটটি সিকন্দরের দখলে আসবে। অর্থাৎ, লাভবান হবে সিকন্দরই। এই তত্ত্ব ধরে তদন্ত এগোতে থাক, যাতে উঠে আসে সিকন্দর সম্পর্কে আরও অনেক সন্দেহজনক তথ্য। কী রকম?

জানা যায়, থানায় যাওয়ার আগে পুষ্পার বাবা পরেশনাথ সিংহকে দু’বার ফোন করেছিল সিকন্দর। দু’বারই সে নিজেকে পাপ্পু হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, গোটা মহল্লায় সে পুষ্পা-পাপ্পু ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথা চাউর করছিল। পাপ্পুর সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ অবশ্য জানতে পারে, সে দিল্লিতে গাড়ি চালানোর কাজ করছে। সিকন্দরের উপরে নজরদারি চলতে থাকে।


একবালপুর থানার সামনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মূল অভিযুক্ত সিকন্দরের মা।

ইতিমধ্যে মেয়ের চরিত্রহননের চেষ্টা হচ্ছে দেখে পরেশনাথবাবু ৪ এপ্রিল ডিসি (বন্দর)-র কাছে সিকন্দরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি দাবি করেন, তাঁর মেয়ে ও দুই নাতনির নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সিকন্দরই জড়িত। পাশাপাশি তোলেন একবালপুর থানার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ। “কিন্তু এত সবের পরেও সিকন্দরের আচরণে কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি। সে দিব্যি ছিল। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিল, নিয়ে আসছিল। দেখে-শুনে আমরাই ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম।” মন্তব্য এক তদন্তকারীর।

শেষমেশ সিকন্দরের দু’টো মোবাইল ফোনের কল-রেকর্ড নিয়ে নাড়াঘাঁটা শুরু হয়। বিশেষ লাভ হয়নি। তবে খবর পাওয়া যায়, সিকন্দর অন্যের নামে নথিভুক্ত একটা সিম থেকেও মাঝেমধ্যে ফোন করে। ১১ তারিখে সেটির কল-রেকর্ড পুলিশের হাতে আসে। দেখা যায়, সিকন্দর সাধারণত রাত ১০টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত নিজের নম্বর বন্ধ রাখলেও ওই সিমটি থেকে ২৯ মার্চ (অর্থাৎ খুনের দিন) রাতভর ও ৩০ মার্চ ভোর থেকে দিনভর কথা বলেছে দু’টি নম্বরে। প্রশ্ন করা হলে সিকন্দর ব্যাখ্যা দেয়, ভাগ্নের বিয়ে ছিল ২৯ মার্চ। তাই পর পর দু’দিন মোবাইলে অত কথা বলতে হয়েছে।

শুনে পুলিশ প্রথমটায় ধন্দে পড়ে যায়। পরে যে দু’জনের সঙ্গে সিকন্দর বহু ক্ষণ কথা বলেছিল, তাদের ডেকে পাঠায়। ওদেরই এক জন হল সিকন্দরের ভাইপো মহম্মদ আমিন, যে কিনা প্রথম রহস্য ফাঁস করে দেয়। পুলিশের দাবি, শনিবার রাতে ঘণ্টা চারেকের জেরায় আমিন ভেঙে পড়ে। বলে, ‘আমরা বড় ভুল করে ফেলেছি। তিন জনকেই মেরে দিয়েছি।’ ‘গ্যাং অফ ফোরের’ দুই নাবালক সদস্যের হদিস সে-ই দেয়। এদের এক জন আবার আমিনের খুড়তুতো ভাই। তদন্তকারীদের সামনেই আমিন তাকে বলে, ‘আমি সব জানিয়ে দিয়েছি। তুইও দে।’

এ বার আর সিকন্দর জাল এড়াতে পারেনি। পুলিশের দাবি, সে মা-মেয়েদের নিকেশ করার ছক কষেছিল পুরোপুরি ঠান্ডা মাথায়। লাশ পাচারের জন্য সে দু’টো বড় টিনের বাক্স তৈরির বরাত দিয়েছিল খুনের সপ্তাহ দুয়েক আগে।

এমনকী মৃতদেহ থেকে যাতে গন্ধ না-ছড়ায়, সে জন্য বাক্সের মধ্যে কর্পুর-ন্যাপথলিনও ভরে রেখেছিল। ৩০ মার্চ ভোরে শববাহী ট্রাঙ্ক দু’টি নিয়ে চার জন নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সিকন্দরের দোকানে যায়। কারও সন্দেহ হয়নি। দোকানের মেঝেতে আগেই গর্ত করা ছিল।

হত্যার অন্যতম অস্ত্র হাতুড়িটির খোঁজ অবশ্য এখনও মেলেনি। তদন্তকারীরা সোমবার জানান, রেল দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পরে ক্ষতিপূরণ ও জীবনবিমা সব মিলিয়ে পুষ্পা মোট ৬৫ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। টাকাটা কোথায় গেল, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sikander ekbalpur aradhana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE