Advertisement
E-Paper

শিশুর মৃত্যু, আঙুল স্কুল ও নার্সিংহোমের দিকেই

স্কুলে গরমের ছুটি পড়ার কথা আজ, শুক্রবার। তার আগেই, বৃহস্পতিবার জীবনের ছুটি হয়ে গেল রাজন্য সরকারের। এ দিন সকালে টিফিনের সময় বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায় সাউথ পয়েন্টের প্রথম শ্রেণির ছাত্র রাজন্য। সেখানেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। স্কুলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাকে স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যান স্কুল-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তত ক্ষণে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৪ ০২:০৯
ময়না-তদন্তের পরে বাড়ির পথে রাজন্য সরকারের দেহ। —নিজস্ব চিত্র।

ময়না-তদন্তের পরে বাড়ির পথে রাজন্য সরকারের দেহ। —নিজস্ব চিত্র।

স্কুলে গরমের ছুটি পড়ার কথা আজ, শুক্রবার। তার আগেই, বৃহস্পতিবার জীবনের ছুটি হয়ে গেল রাজন্য সরকারের।

এ দিন সকালে টিফিনের সময় বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায় সাউথ পয়েন্টের প্রথম শ্রেণির ছাত্র রাজন্য। সেখানেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। স্কুলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাকে স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যান স্কুল-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তত ক্ষণে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কাঁটাপুকুর পুলিশ মর্গে ময়না-তদন্তের পরে রাতেই কেওড়াতলা শ্মশানে রাজন্যের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে তার পরিবার। সেখানে অবশ্য স্কুলের কোনও প্রতিনিধি ছিলেন না।

কী ভাবে মৃত্যু হল শিশুটির?

রাজন্যের পরিবারের বক্তব্য, তাদের ছেলের কোনও রোগ ছিল না। গত দু’বছরে সর্দি-কাশি বা জ্বর ছাড়া অন্য কোনও অসুখে ভোগেনি। এ দিন সকালে যখন তার মা স্কুলে পৌঁছে দেন, তখনও সে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ঢুকে গিয়েছিল ভিতরে। আর-পাঁচটা দিনের মতোই। তা হলে এমন কী হল যে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল না, প্রশ্ন রাজন্যের আত্মীয়স্বজনের। তাঁদের অভিযোগ, প্রথমে স্কুল-কর্তৃপক্ষ এবং পরে নার্সিংহোমের গাফিলতিতেই রাজন্যের মৃত্যু হয়েছে। স্কুল যদি প্রাথমিক চিকিৎসায় সময় নষ্ট না-করে দ্রুত নার্সিংহোমে নিয়ে যেত এবং সেখানে চিকিৎসকেরা যদি সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করতেন, তা হলে তাদের ছেলের এ ভাবে বেঘোরে মৃত্যু হত না। মৃতের পরিবারের অভিযোগ, রাজন্যকে যখন নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেখানে কোনও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। এমনকী চিকিৎসা-পরিকাঠামোতেও গলদ ছিল।

সাউথ পয়েন্ট স্কুল অবশ্য রাজন্যের পরিবারের অভিযোগ মানতে চায়নি। স্কুল-কর্তৃপক্ষের দাবি, স্কুলের তরফে কোনও গাফিলতি হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব, রাজন্যকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু নার্সিংহোমের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে ওই ছাত্রের মৃত্যু নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। ঠিক কী ভাবে রাজন্যের মৃত্যু হল, রাত পর্যন্ত তা অজানাই থেকে গিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেও শরীরে আঘাতের চিহ্ন মেলেনি বলে উল্লেখ রয়েছে। সবিস্তার রিপোর্ট এলে মৃত্যুর যথার্থ কারণ জানা যাবে।

যদিও মৃতের পরিবারের তরফে দু’টি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গড়িয়াহাট থানায় অভিযোগ আনা হয়েছে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের অধ্যক্ষা এবং অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। আর সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে কড়েয়া থানায় ।

রাজা ও রুচিরা সরকারের একমাত্র সন্তান রাজন্য। থাকত বাঘা যতীনের বি-৫ ব্লকে। ওই পরিবারের বন্ধু বরুণদেব চৌধুরী বলেন, “ছেলেটাকে নার্সিংহোমে ভর্তির অনেক পরে বাড়ির লোককে জানানো হয়েছে। তাই লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে পুলিশের কাছে। স্কুলের সিসিটিভি-র ফুটেজও পেতে চাই আমরা।”

স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেন, স্কুল-কর্তৃপক্ষের ভরসাতেই বাচ্চাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও যদি এত অব্যবস্থা, এত গাফিলতি থাকে, তা হলে অভিভাবকেরা যাবেন কোথায়? এক অভিভাবক বলেন, “রাজন্যের কথা ভাবতেই শিউরে উঠছি।”

শুধু শিউরে ওঠাই নয়। ক্ষিপ্ত অভিভাবকদের একাংশ নানান অভিযোগ তুলে এক সময় স্কুলের গেটে ধাক্কা মেরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। আবার অন্য এক দল অভিভাবকই কোনও রকমে তাঁদের সামলান। পুলিশ আসে। গত সেপ্টেম্বরে দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের মৃত্যু ঘিরে ব্যাপক বিক্ষোভ ও ভাঙচুর হয়েছিল। তবে এ দিন সাউথ পয়েন্টের ঘটনায় পঠনপাঠনে ব্যাঘাত ঘটেনি। অন্যান্য দিনের মতো পূর্ণ সময় স্কুল হয়েছে সকাল ও দুপুর দু’পর্বেই।

কিন্তু গাফিলতির অভিযোগের ব্যাপারে স্কুল কী বলছে?

রাজন্যের পরিবারের অভিযোগ মানতে চাননি স্কুল-কর্তৃপক্ষ। বিকেলে স্কুলেই সাংবাদিক বৈঠক করে অধ্যক্ষা দলবীর কৌর চাড্ডা ও অধিকর্তা মধু কোহলি দাবি করেন, তাঁদের তরফে কোনও গাফিলতি হয়নি। গত ৭ এপ্রিল রাজন্য সাউথ পয়েন্টে ভর্তি হয়। ঘটনাটি ঘটে এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ৯টা ৫০ মিনিটের মধ্যে। তখন টিফিন চলছিল। তেতলার ক্লাস থেকে বন্ধুদের সঙ্গেই দোতলায় নেমেছিল রাজন্য। আচমকা কম্পিউটর রুমের সামনে সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায় বলে জানান স্কুল-কর্তৃপক্ষ।

রাজন্য যেখানে পড়ে গিয়েছিল, তার পাশেই টিচার্স রুম। দেবলীনা বসু নামে এক শিক্ষিকা সামনেই ছিলেন। তিনি রাজন্যকে তুলে সিক রুমে নিয়ে যান। সেখানেই ছিল অক্সিজেন মাস্ক। স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানান, ওই ঘটনার ১০ মিনিটের মধ্যে কৃষ্ণা মণ্ডল নামে এক ‘ফ্লোর অ্যাটেন্ড্যান্ট’ রাজন্যের মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেন। তার পরে স্কুলবাসে উঠিয়ে কাছের একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রাজন্যের সঙ্গে ছিলেন অধ্যক্ষা, মেট্রন এবং কয়েক জন শিক্ষাকর্মী। তাঁদের কথায়, “বাচ্চাটার মুখ নীল হয়ে যাচ্ছিল। নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পরে পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানান, রাজন্য মারা গিয়েছে।”

স্কুলের বক্তব্য, নার্সিংহোমে পাঠানোর পরে ওই ছাত্রের নাম ও ক্লাসের খোঁজ শুরু হয়। বহু ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পরিচয় বার করতে একটু সময় লেগে যায়। অধ্যক্ষার দাবি, ছেলের খবর জানানোর জন্য দু’-দু’বার তার মাকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। শেষে সওয়া ১০টা নাগাদ বাবাকে ফোন করে ওই খবর জানানো হয়।

নার্সিংহোম-কর্তৃপক্ষও রাজন্যের পরিবারের যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নার্সিংহোমের ম্যানেজার সমীর ঘোষ বলেন, “বাচ্চাটি আসার পরেই আউটডোরে চার জন চিকিৎসক তার চিকিৎসা করেন। কিন্তু আগেই ওর মৃত্যু হয়েছিল।”

এ ভাবে হঠাৎ মৃত্যুর কারণ কী?

জয়দেব রায় বা দ্বৈপায়ন ঘটকের মতো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞেরা জানান, অনেক শিশুর জন্ম থেকেই হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা থাকে, যা এমনিতে বোঝা যায় না। প্রথম হার্ট অ্যাটাকেই তা জানান দেয়। কিন্তু তখন কিছু করার থাকে না। ‘হাইপারঅ্যাকটিভ অবস্ট্রাকটিভ কার্ডিও মায়োপ্যাথি’ নামে রোগ থাকলেও হৃদ্যন্ত্রে রক্ত চলাচল আচমকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় স্নায়ুর জটিল রোগে মস্তিষ্কের রক্তজালিকা ফেটে গিয়ে বিপদ ডেকে আনতে পারে।

south point school death student rajyna sarkar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy