প্রেক্ষাগৃহের পিছন দিকে বেরোনোর দরজা, যা খোলা হয় না।
দেখেও না-দেখা বা চরম গা-ছাড়া হাবভাবের ছবিটা সেই একই রকম। শহরের ঘিঞ্জি মহল্লা বা পুরনো বহুতলের জতুগৃহে যা দেখা যায়, সংস্কৃতির অভিজাত খাসতালুকও তার থেকে আলাদা নয়। অ্যাকাডেমির মঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের জেরে এটাই বেআব্রু হয়ে গিয়েছে।
সমাজের বিশিষ্ট মুখ হিসেবে পরিচিত খোদ নাট্যকর্মীরাও বিষয়টি অস্বীকার করছেন না। এর পিছনে নিজেদের ‘নৈতিক দায়টুকু’ও তাঁদের অনেকেই মেনে নিচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ আগুনের ঘটনার ধাক্কায় শহরের অন্যত্র যা ঘটে থাকে, এ ক্ষেত্রে তা ঘটছে না। দমকল বা পুলিশের তদন্ত চলতে চলতেই প্রেক্ষাগৃহে পরবর্তী নাটকের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার ফরেন্সিক পরীক্ষার জেরে অ্যাকাডেমিতে ‘শো’ বন্ধ থাকলেও আজ, শনিবার বিকেলেই নাটকে ফিরছে অ্যাকাডেমি।
নাটক চলাকালীন মঞ্চের পর্দায় আগুন লেগে এ যাত্রা প্রাণহানি বা বড়মাপের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আতঙ্ক নেহাত কম ছিল না। বিশেষত, দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোনোর কার্যত একটিমাত্র দরজা খোলা রেখে অভিনয়ের জেরে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। ধোঁয়ায় ঢাকা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে দিশাহারা দর্শক বা নাট্যকর্মীদের অনেকেরই মৃত্যুভয় ঘনিয়ে উঠেছিল। অ্যাকাডেমি সূত্রের খবর, কোনও ‘শুভানুধ্যায়ী’র সাহায্যে আপাতত মঞ্চের পুড়ে যাওয়া পর্দা সারিয়ে নিয়েই ফের নাটক শুরু হয়ে যাচ্ছে। এ দিন ফরেন্সিক পরীক্ষার আগেই শনিবারের শো-এর টিকিট বিক্রির কাউন্টার খুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, ফরেন্সিক দল আসার আগেই প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চ ধুয়ে ফেলা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন।
বৃহস্পতিবার রাতের অগ্নিকাণ্ডের পরে শুক্রবার চলছে মঞ্চ সাফাইয়ের কাজ।
তবে দমকল বা ফরেন্সিক কর্তারা বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে চাননি। এমনকী, অ্যাকাডেমিতে ফের নাটক শুরুর দিনক্ষণ নিয়েও দমকল বা পুলিশ পদক্ষেপ করছে না। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র ফের অভিনয় শুরুর বিষয়টি দমকলের এক্তিয়ারভুক্ত বলে মন্তব্য করেন। দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা কাউকে ওই মঞ্চে অভিনয়ের অনুমতি দিচ্ছি না। কাউকে নিষেধও করছি না।”
অ্যাকাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির ডিরেক্টর বুলবুল রায় হেস্টিংস থানায় এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে একটি অভিযোগ নথিবদ্ধ করেছেন। তবে এখনও কোনও মামলা শুরু হয়নি। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছেন, মঞ্চের উপরে ১০০০ ওয়াটের একটি আলো তেতে গিয়ে পর্দায় (মিডকার্টেন) আগুন ধরে যায়। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন দমকলের ডিজি।
তবে ঘটনা হল, দমকলে ছাড়পত্র ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে অভিনয় চলছিল অ্যাকাডেমিতে। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকাসনের ডান দিকে বাইরে বেরোনোর একটি দরজা থাকলেও তা বন্ধই থাকত সাধারণত। বৃহস্পতিবার সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটক চলাকালীনও ওই দরজা খোলা ছিল না। পাশাপাশি, অ্যাকাডেমির দোতলাতেও একটিমাত্র সিঁড়ি। তাতে আগুন ধরলে উপরের দর্শকদের পালানোর কার্যত উপায়ই নেই। বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ড প্রেক্ষাগৃহের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকেই আঙুল তুলেছে।
সেই সঙ্গে আঙুল উঠছে খোদ নাট্যকর্মীদের দিকেও। এ রাজ্যের গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীরা মাঝেমধ্যেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব হন। অথচ, তাঁরাই নিজেরা অভিনয় করার সময়ে প্রেক্ষাগৃহের বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিয়ে কার্যত উদাসীন থেকে গিয়েছেন।
নাট্যকর্মী তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু যেমন বলছেন, “অ্যাকাডেমিতে বরাবরই এ ভাবেই নাটক হয়েছে। আশা করব, এর পরে নিরাপত্তার দিকটা খেয়াল রাখা হবে।” তৃণমূল সাংসদ তথা নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষও মনে করেন, অ্যাকাডেমির পরিস্থিতি শুধরোতে আপাতত কয়েকটি ছোটখাটো সতর্কতার দিকে খেয়াল রাখাই যথেষ্ট। তাঁর মতে, “এ বার থেকে নাটক চলাকালীন ডান দিকের দরজাটা খোলা রাখা হোক। দোতলা বা ব্যালকনিতেও সব টিকিট বিক্রি করা উচিত নয়। বিপদ হলে সিঁড়িতে ধাক্কাধাক্কিতেও সমস্যা হতে পারে।”
অ্যাকাডেমির সমস্যাটা কিন্তু স্রেফ প্রেক্ষাগৃহের কিছু ত্রুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এমনটাও মনে করেন কোনও কোনও নাট্যকর্মী। সুমন মুখোপাধ্যায়ের মতে, বিষয়টা এক ধরনের সামাজিক ব্যাধির প্রতিফলন। তাঁর কথায়, “ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। বিপজ্জনক বাড়ি বা রাস্তাঘাটের কিছু বিপদের মতো নাটকের অভিনয়ের সময়েও কাঙ্ক্ষিত সতর্কতায় খামতি রয়েছে।” কিন্তু এত বড় সমস্যা কী ভাবে গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীদের মতো সচেতন নাগরিকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে?
কৌশিক সেনের মতে, “নাটকের দলগুলোর নানা অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে। পরিকাঠামো নিয়ে নানা আপস করে চলতেই আমরা অভ্যস্ত। এ ভাবে চলতে গিয়েই মারাত্মক বিপদের কিছু দিক হয়তো খেয়াল করা হয়নি। এটা আমাদেরই দোষ!” বর্ষীয়ান নাট্যকর্মী বিভাস চক্রবর্তীরও স্বীকারোক্তি, “অ্যাকাডেমিতে একটা শো পাওয়ার জন্য নাটকের দলগুলো সবাই হন্যে হয়ে তাকিয়ে থাকি! তাই হলের সমস্যাগুলো জানলেও ঝঞ্ঝাট এড়াতেই এত দিন কেউ সে-ভাবে কথা বলিনি!”
এক দিনের বিরতির পরে বিভাস চক্রবর্তীর দলের নাটক দিয়েই শো শুরু হচ্ছে অ্যাকাডেমিতে। বিপদের ঝুঁকি থাকলেও বর্ষীয়ান নাট্যকর্মী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তও অ্যাকাডেমিতে ফের নাটক শুরু করার পক্ষেই সওয়াল করছেন। তাঁর মতে, “কলকাতা জুড়েই পরিকল্পনাহীনতার ছাপ। কিন্তু তাতেই প্রাণশক্তি। মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি!”
অ্যাকাডেমির পরিস্থিতির জন্য প্রেক্ষাগৃহের প্রশাসনের প্রতি তাঁর ক্ষোভও উগরে দিয়েছেন রুদ্রবাবু “কবন্ধের মতো চলছে হলটা! হয়তো দুর্ঘটনার পরে একটা সমন্বয় আসবে!” বাস্তবিক অ্যাকাডেমির নিয়ন্ত্রক বেসরকারি অছি পরিষদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির চাপান-উতোরে প্রেক্ষাগৃহের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। অ্যাকাডেমির কাজকর্ম পরিচালনা ও নিয়মিত হিসেব পেশ না-করার অভিযোগ তুলে অছিরা সম্প্রতি ইস্তফা দিয়েছেন। কার্যনির্বাহী কমিটি থাকলেও তাদের আর্থিক ক্ষমতা নামমাত্র। ফলে, কর্মচারীদের বেতন থেকে শুরু করে হলের রক্ষণাবেক্ষণ বিশ বাঁও জলে।
তবু কর্মচারী ও নাট্যকর্মীদের মধ্যে অনেকেই যে ভাবে হোক অ্যাকাডেমিতে নাটক শুরু করার পক্ষপাতী। কর্মচারীদের মত, এমন দুর্ঘটনা যখন আগে ঘটেনি, তাকে এতটা আমল দেওয়ার মানে হয় না। কার্যনির্বাহী কমিটির ডিরেক্টর বুলবুলদেবী অবশ্য মনে করছেন, নাটক শুরু করা নিয়ে অহেতুক তাড়াহুড়ো হঠকারিতা হতে পারে। তিনি বলেন, “শুনেছি ইস্তফা দিলেও কোনও একজন ট্রাস্টি পুড়ে যাওয়া পর্দা সারাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা চেয়েছিলাম, দমকলে ছাড়পত্র নিয়েই ফের নাটক শুরু করা হোক।” অ্যাকাডেমির সঙ্কটের আবহে আজ, শনিবার নাট্যকর্মীদের একাংশও বিকেলে হলের সামনে জড়ো হচ্ছেন।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy