Advertisement
২০ মে ২০২৪
নিষেধ উড়িয়ে নৌকায় ঝাঁপ

কখন চলবে ভুটভুটি, ধৈর্য হারিয়েই বিপত্তি

প্রতি বছরই ভবা পাগলার মেলায় গাঁ উজাড় করে লোক আসে। তবে এ বার যেন ভিড়টা আরও বেশি হয়েছিল।

বাঁ দিক থেকে, নৃসিংহপুর ঘাটে নৌকার আগুন নেভাতে ব্যস্ত পুলিশ।  জ্বলছে কালনা পুরসভার লঞ্চ। নিখোঁজদের খুঁজতে ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি কালনা খেয়াঘাটে । মধুমিতা মজুমদারের তোলা ছবি।

বাঁ দিক থেকে, নৃসিংহপুর ঘাটে নৌকার আগুন নেভাতে ব্যস্ত পুলিশ। জ্বলছে কালনা পুরসভার লঞ্চ। নিখোঁজদের খুঁজতে ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি কালনা খেয়াঘাটে । মধুমিতা মজুমদারের তোলা ছবি।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
কালনা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০১:৪২
Share: Save:

প্রতি বছরই ভবা পাগলার মেলায় গাঁ উজাড় করে লোক আসে। তবে এ বার যেন ভিড়টা আরও বেশি হয়েছিল।

শনিবার সকাল থেকেই একের পর এক ভুটভুটি বোঝাই করে নদিয়ার নৃসিংহপুর ঘাট থেকে লোক আসছিল কালনায়। মাঝিরাও দু’পয়সা বেশি রোজগারের টানে সকাল থেকে নৌকা টানছিলেন। তবে রাতের ঝড়-বৃষ্টিই বদলে দিল ছবিটা। সারা দিনের আনন্দ নিভে গেল এক লহমায়।

বহু বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এসে কালনায় ভবানী মন্দির গড়েছিলেন সাধক কবি ভবা পাগলা। বৈশাখের শেষ শনিবার বিশেষ উৎসব হয় সেখানে। বর্ধমান, নদিয়া তো বটেই অন্য জেলা থেকেও হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। ভক্তদের একটা বড় অংশ আসেন নদীপথে। রাত পর্যন্ত চলে ফেরি চলাচল। গত কয়েকদিনে আবহাওয়া তেমন বেগড়বাঁই না করায় এ বার নদীপথেই আসা ভক্তদের সংখ্যা ছিল বেশি। সকাল থেকেই ঘাটে পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকার অভিযোগও করছিলেন অনেকে। অভিযোগ ছিল, ভিড় এড়ানোর জন্য অস্থায়ী ঘাট নেই। নৌকায় ওঠার লাইন বজায় রাখার কড়া নজরদারিও নেই। তার মধ্যেও নির্বিঘ্নেই চলছিল ভুটভুটি।

রাত বাড়তে ভিড় বাড়ে। সন্ধ্যা ৮টা নাগাদ শুরু হয়ে যায় ঝড়, বৃষ্টি, বাজ পড়া। মাঝিরা, ঘাটের ইজারাদারেরা বিপদ আঁচ করে ভুটভুটি চলাচল বন্ধ করে দেন। ভিড় বাড়তে থাকে ঘাটে। দেড় ঘণ্টায় কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়ে যায়। মেলাফেরত ভক্তেরা তো বটেই, শান্তিপুরে কাজে যাওয়া বা এ পাড়ে কাজ সেরে বাড়ির পথে যাওয়া বহু লোকও ছিলেন সেখানে। ছিল বহু সাইকেল, মোটরবাইকও। নৌকা না পেয়ে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এমনকী, ঘাটের ইজারাদারদের আসবাবপত্রও ভাঙচুর করতে শুরু করেন কয়েকজন। ভিড়, গোলমালের খবর পেয়ে পুলিশ বাহিনি নিয়ে পৌঁছন কালনার ওসি সনৎ দাস, এসডিপিও ওয়াই রঘুবংশি। মাইকে লাইন করে নৌকায় ওঠার কথা ঘোষণা শুরু হয়। মাঝি, ইজারাদারেরাও বারবার হুড়োহুড়ি করতে নিষেধ করেন। কিন্তু হাজার হাজার লোকের ভিড় ঠেলে জেটি পর্যন্ত পুলিশ পৌঁছনোর আগেই ঘাটে ভেড়ে একটি ভুটভুটি। যেখানে ৬০ জন ধরে, সেখানে ঝাঁপ দেন প্রায় দু’শো জন। সঙ্গে সাইকেল, মোটরবাইক। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা ঝাঁপে ভুটভুটির দড়ি ছেঁড়ে, নৌকাও টাল খেয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নৌকা ভেঙে ডুবে যায় ভাগীরথীতে। কেউ কেই শেষ মুহূর্তে লাফ দেন জেটিতে। পুলিশ, আশপাশের লোকজন মিলে উদ্ধার করেন বহু মানুষকে। তারপরেও রবিবার রাত পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি জনা দশেকের। প্রশাসনের দাবি, তাঁদের বেশির ভাগই নদিয়ার শান্তিপুরের বাসিন্দা।

জলে হাবুডুবু খেয়ে কোনও রকমে প্রাণে বাঁচেন নদিয়ার রানাঘাটের বাসিন্দা রামপ্রসাদ চৌধুরী। তাঁর আবার অভিযোগ, প্রচুর মানুষ যখন একসঙ্গে নৌকায় উঠতে যাচ্ছিলেন তখন পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না। নাহলে লাইন করে নৌকায় ওঠা বা আটকানোর ব্যবস্থা করতে পারত। তাঁর দাবি, ‘‘পুলিশের উচিত ছিল ভিড়ের সময় ব্যারিকেড করে গুণে গুণে নৌকায় লোক তোলা। সেটা না করায় বিপদ হয়ে গেল।’’ পেশায় তবলাবাদক গোবিন্দ গোস্বামীও ভবানী মন্দিরে অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘যে নৌকাটি ডুবে যায় তাতে আমি ছিলাম। যা পরিস্থিতি ছিল পুলিশি ঠিকঠাক তৎপরতা দেখালে সব্বাইকে নিরাপদে তোলা যেত।’’ নিখোঁজ দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ঝুম্পার এক মামা দাবী করেন, ‘‘পুলিশ সতর্ক থাকলে এই ঘটনা ঘটত না। উল্টে ঘটনার পরে পুলিশকে লাঠি চার্জ করতে দেখা যায়।’’ যদিও পুলিশ, প্রশাসন থেকে ঘাটের ইজারাদার কেউই তা মানতে চাননি। তাঁদের দাবি, ভিড়ে জেটি পর্যন্ত পৌঁছনো যায়নি। দুর্ঘটনার পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ভিড়, বিক্ষোভের মুখে পড়ে পাত একটা নাগাদ ফের তা চালু করা হয়। তখন লাইন করে যাত্রীদের নৌকায় তোলা হয়। তাঁরাও হুড়োহুড়ি না করে নির্দেশ মেনে নেন। রাতে ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশান্ত চৌধুরী, কালনার বিদায়ী বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু, পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ বাগ ও বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর।

রবিবার সকালেও নিখোঁজদের পরিবার, পরিজনেরা উদ্ধার কাজ নিয়ে ক্ষোভ জানাতে থাকেন। তাঁদের অভিযোগ, সকাল পর্যন্ত ডুবুরি আনতে ব্যর্থ হন প্রশাসনের আধিকারিকেরা। পুলিশের কয়েকজন কর্তার সঙ্গে তাঁদের বচসাও বেধে যায়। কালনা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আটকে থাকা শ’পাঁচেক মানুষকে সকাল আটটা নাগাদ একটি বার্জে চাপিয়ে ও পারের ঘাটে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ করা হয়। কিন্তু বার্জটি নদিয়ার নৃসিংহপুর ঘাট ছোঁয়ার আগেই কিছু উন্মত্ত মানুষ ইটবৃষ্টি শুরু করেন। বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে আনতে হয় বার্জ। খেয়া পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়েই যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিয়ে সড়ক পথ ধরে পৌঁছন নদিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে।

এই সময় কালনা খেয়াঘাটে হাজির ছিলেন বিদায়ী মন্ত্রী তথা বর্ধমান জেলা তৃণমূলের সভাপতি স্বপন দেবনাথ। স্বপনবাবু বলেন, ‘‘নৌকাডুবির ঘটনাটি দুঃখজনক। তবে নৌকা ও লঞ্চে অগ্নিসংযোগ ঠিক হয়নি।’’ ডুবুরি আনতে গাফিলতিও মানতে চাননি তিনি। কালনা থানার এক আধিকারিকও জানান, খেয়াঘাটের পাশাপাশি বেশ কিছু পুলিশ মোতায়েন ছিল ভবানী মন্দির সংলগ্ন মেলা প্রাঙ্গণে। সাড়ে দশটার পরে খেয়াঘাটে মাত্রাছাড়া ভিড়ের কথা জেনেই এসডিপিও, ওসি-ও এসে যান। ফলে উদ্ধার কাজে দেরি হয়নি। পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ বাগ বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পর থেকে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়েছেন পুলিশ কর্মীরা।’’

তবে ভবা পাগলার মেলায় আগে কখনও এমন হয়নি বলেই দাবি করছেন এলাকার প্রবীণেরা। যদিও এ দিনের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

boat plunges kalna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE