ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হচ্ছে মোফাজ্জুল শেখ ওরফে লাদেনকে।—নিজস্ব চিত্র।
নিজে গড়ে তুললেও মকিমনগর মাদ্রাসার পরিচালন ভার পরবর্তী সময়ে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর হাতে তুলে দিয়েছিল মোফাজ্জুল শেখ ওরফে লাদেন। ভেঙে দিয়েছিল লালগোলার ওই মাদ্রাসার পুরনো পরিচালন সমিতি। মকিমনগর মাদ্রাসার মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা মোফাজ্জুলকে প্রাথমিক ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমনটাই জানা গিয়েছে বলে দাবি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে অভিযুক্ত মোফাজ্জুল ধরা পড়ার পর তাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, ২০০৮-এ মোফাজ্জুল মকিমনগরে নিজের বাড়িতে ওই মাদ্রাসা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ২০১১-য় ওই মাদ্রাসা পুরোপুরি চলে আসে জেএমবি-র কব্জায়। সে বছরই মুর্শিদাবাদের ওই মাদ্রাসায় নিয়মিত আনাগোনা শুরু হয় সাজিদ ওরফে মাসুদ রানা ও হাতকাটা নাসিরুল্লার মতো বাংলাদেশের জঙ্গি-চাঁইদের। মকিমনগরের ওই মাদ্রাসা ক্রমশ জঙ্গিদের গোপন আশ্রয় ও জেহাদি প্রশিক্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয় বলে তদন্তকারীদের বক্তব্য।
এনআইএ সূত্রের খবর, মোফাজ্জুলকে জেরা করে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ, বর্ধমানের কাটোয়া ও বীরভূমের বোলপুরের কাছে এমন আরও কয়েকটি জঙ্গি ডেরার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যেখানে নিয়মিত জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। মোফাজ্জুলের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার পর ওই তিনটি জঙ্গি-ঘাঁটিতে শীঘ্রই হানা দেবেন গোয়েন্দারা।
শুক্রবার কলকাতার নগর দায়রা আদালতে মোফাজ্জুলকে হাজির করানো হয়। বিচারককে এনআইএ-র আইনজীবী জানান, বর্ধমান বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সঙ্গে মোফাজ্জুলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তার মাদ্রাসায় কাজকর্ম চলত বারতীয় সময় নয়, সৌদি আরবের সময় মেনে। তা ছাড়া সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণও চলত। এনআইএ-র তরফে দাবি করা হয়, মোফাজ্জুল তার দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে আট নাবালক সন্তানকে জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল। বিচারক মোফাজ্জুলকে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনআইএ-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, মোফাজ্জুলের মাদ্রাসা কার্যত তারই মদতে বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েক জন সন্দেহজনক লোক কব্জা করতে চাইছে দেখে পরিচালন সমিতির সদস্য তথা কয়েক জন শিক্ষক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁরা দেখেন, উগ্র মতবাদ ও কট্টরপন্থী মতাদর্শ মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে ঢোকানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু ওই শিক্ষকদের আপত্তি ধোপে টেঁকেনি। শেষমেশ তাঁরা ইস্তফা দিলে মাদ্রাসার পরিচালন সমিতিও ভেঙে দেন মোফাজ্জুল। এর পরই মকিমনগরের ওই মাদ্রাসা চলতে থাকে সম্পূর্ণ অন্য খাতে।
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “২০১১ সালে জেএমবি-র নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি চলে আসার পর মকিমনগরের ওই মাদ্রাসার চরিত্রটাই বদলে যায়। ওটা মহিলাদের মাদ্রাসায় পরিণত করা হয়।” এনআইএ-র বক্তব্য, সুপরিকল্পিত ভাবেই এই কাজ করা হয়েছিল। কারণ, মহিলাদের মাদ্রাসা হলে বাইরের লোকজন সেখানে হুটহাট ঢুকে পড়তে পারবে না আর সেই সুযোগে জঙ্গিরা সেটাকে নিশ্চিন্তে ডেরা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
এনআইএ-র এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “আমরা যতটুকু জেনেছি, মকিমনগর মাদ্রাসাই ছিল পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি-র প্রথম বড় ডেরা। মোফাজ্জুল বা লাদেনের মদত ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কেন সে নিজের গড়া মাদ্রাসা জেএমবি-র হাতে তুলে দিতে গেল, সেই ব্যাপারে মোফাজ্জুলকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।”
এই ব্যাপারে গোয়েন্দাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তদন্তকারীদের একাংশ মনে করেন, দরিদ্র মোফাজ্জুল আর্থিক প্রলোভনে পড়েই এমনটা করেছিল। তাকে মোটা টাকা দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ওই মাদ্রাসা কব্জা করে নিয়েছিল জেএমবি। আর বেছে বেছে মকিমনগর মাদ্রাসাই বেছে নেওয়ার কারণ, বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত টপকে লালগোলার এই জায়গায় ঢুকে পড়া সহজ। একটা সময়ে মোফাজ্জুল মুর্শিদাবাদ থেকে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে ঠিকা শ্রমিক পাঠিয়ে রোজগার করত বলে জেনেছে এনআইএ। আবার কয়েক জনের সঙ্গে মিলে মোফাজ্জুল একটি ইটভাটা তৈরি করলেও পরে অভাবে পড়ে সে নিজের মালিকানার অংশ বেচে দেয়। এই সব কারণে মোফাজ্জুলকে মোটা টাকা দিয়ে সহজেই জেএমবি তার মাদ্রাসার দখল নেয় বলে গোয়েন্দাদের একাংশের ধারণা।
তবে তদন্তকারীদের অন্য কয়েক জন মনে করেন, জেএমবি-র সঙ্গে মোফাজ্জুলের যোগাযোগ ছিল ২০০৭ থেকেই। তার বছর খানেকের মাথায় মোফাজ্জুল যে মাদ্রাসা তৈরি করেছিল, পরিকল্পনা মাফিক তাতে অনেকটাই আর্থিক সাহায্য করেছিল বাংলাদেশের ওই জঙ্গি সংগঠন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পরে ওই মাদ্রাসাকে জঙ্গি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। সত্যিটা কী, সেটাই খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy