Advertisement
E-Paper

‘অশোকদা’কে দেখতে ভেঙে পড়ল সুইসা

পুরুলিয়ার মাটিতেই শেষ শয্যা নিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ। অর্ধশতক আগে তিনি পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য যে আশ্রম গড়েছিলেন, বাঘমুণ্ডির সুইসা গ্রামে সেই ‘নেতাজি সুভাষ আশ্রমে’ রবিবার তাঁর কফিনবন্দি দেহ সমাহিত করা হয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৬ ০৩:১৫
ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সুইসার আশ্রমে সমাহিত করা হল। তার আগে গান স্যালুট দিয়ে সম্মান জানানো হয়।—সুজিত মাহাতো

ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সুইসার আশ্রমে সমাহিত করা হল। তার আগে গান স্যালুট দিয়ে সম্মান জানানো হয়।—সুজিত মাহাতো

পুরুলিয়ার মাটিতেই শেষ শয্যা নিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ। অর্ধশতক আগে তিনি পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষের উন্নয়নের জন্য যে আশ্রম গড়েছিলেন, বাঘমুণ্ডির সুইসা গ্রামে সেই ‘নেতাজি সুভাষ আশ্রমে’ রবিবার তাঁর কফিনবন্দি দেহ সমাহিত করা হয়। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যেমন বামফ্রন্টের কেন্দ্র ও রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে জেলা নেতারা ছিলেন, তেমনই এসেছিলেন অগুণতি মানুষ। রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, বর্ষীয়ান ফব নেতা দেবব্রত বিশ্বাসরা যখন কবরে মাটি দিচ্ছেন, তখন আশ্রমে ভেঙে পড়া ভিড়ের চোখে-মুখে স্বজন হারানোর শোক। এই দিনটাই নতুন করে বুঝিয়ে দিল আশোকবাবু জঙ্গলমহলের এই প্রত্যান্ত এলাকার বাসিন্দাদের কাছে কতটা ‘কাছের মানুষ’ ছিলেন।

শনিবার রাতেই অশোকবাবুর মরদেহ পৌঁছে গিয়েছিল পুরুলিয়া শহরের দলীয় কার্যালয়ে। সেখানে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-কর্মীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। দলের জেলা সম্পাদক নরহরি মাহাতোর বলেন, ‘‘ভাবতেই পারছিলাম না যে অশোকদা আর নেই। তাঁর গলার স্বরটা এখনও যেন কানে বাজছে।’’ অশোকবাবুর মৃত্যু যেন এ দিন অনেককে মিলিয়ে দিলেন, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য। রবিবারই নিজের ভাইকে হারিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো। এ দিন সকালে তিনিও অশোকবাবুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চলে এসেছিলেন। এসেছিলেন অশীতিপর সিপিএম নেতা নকুল মাহাতো। তাঁকে হাত ধরে অশোকবাবুর দেহের কাছে নিয়ে যান শান্তিরামবাবু। এসেছিলেন বাসুদেব আচারিয়া, নরেন চট্টোপাধ্যায়, নরেন দে থেকে জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতোও। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সুইসায় উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শ্রম মন্ত্রী মলয় ঘটক। রেলের শ্রমিক সংগঠন দক্ষিণ-পূব রেলওয়ে মজদুর সংঘের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিমানবাবু বলেন, ‘‘অশোকদা শেষের দিকে একদমই চোখে দেখতে পেতেন না। তবুও আন্দোলন, সংগ্রামে অশোকদার শারীরিক উপস্থিতি বাম আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে। তিনি তিল তিল করে বামফ্রন্টকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।’’

চাষ মোড়, ফরেস্ট মোড়, জয়পুর, কোটশিলা, ঝালদা, জারগো, কালিমাটি মোড়, তুন্তুড়ি হয়ে অশোকবাবুর দেহ তাঁর আশ্রমে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। সকাল থেকে অপেক্ষায় থাকা শয়ে শয়ে মানুষের কাঠফাটা রোদে তখনও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি। অশোকবাবু প্রতিবার নেতাজি মেলায় এখানে আসতেন। কিন্তু ২০০৬ সালের পর থেকে বয়সজনিত সমস্যায় আর এখানে তিনি আসতে পারেননি। তাই তাঁকে একটিবার দেখার জন্য অপেক্ষা করে গিয়েছেন বাসিন্দারা। কারণ তাঁদের কাছে তিনি শুধু একজন নেতা নন, আক্ষরিক অর্থেই এলাকার আপনজন হয়ে উঠেছিলেন।

এখানকার মানুষের উন্নয়নের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরপরই অশোকবাবু সঙ্গে ক্রমশ যোগাযোগ গড়ে ওঠে সুইসার। সভাসমিতি থেকে সংগঠন বাড়াতে হামেশাই তাঁকে এখানে আসতে হয়। প্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর আর্দশে অনুশীলন সমিতির সদস্য বিপ্লবী হরিনারায়ণ চন্দ্রের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন এই আশ্রম। সেখানে রাজনৈতিক পাঠ দেওয়া থেকে উন্নয়নের নানা কাজ ও স্থানীয় সংস্কৃতি নিয়ে কাজ শুরু হয়।

আশ্রম প্রাঙ্গণে লাল কার্পেটের উপরে শোয়ানো নেতার দেহ দেখে অতীতে ফিরে গিয়েছিলেন প্রাক্তন ফব সাংসদ বীরসিংহ মাহাতো। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার বাবা এখানে অশোকদার সহকর্মী ছিলেন। বাবার কাছেই শুনেছি, একবার গরুর গাড়িতে করে বাবা ও অশোকদা ঝালদায় যাচ্ছিলেন। গাড়ির লিঘা ভেঙে যাওয়ায় পথে তাঁরা বিপদে পড়েন। সেই সময়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় সাইকেলে আসা কংগ্রেস নেতা দেবেন মাহাতোর। তিনি জিপের ব্যবস্থা করে অশোকবাবুদের ঝালদা যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।’’ তিনি জানান, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে অশোকবাবু নিজে বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এইসব এলাকার মাটির রাস্তাগুলো পাকা করেছেন। কলেজ স্থাপন করা-সহ অনেক কাজই তিনি করেছিলেন। অশোকবাবুকে ঘিরে এমনই নানা ঘটনা ভাসতে থাকে এ দিন আশ্রমে। নওয়াডি গ্রামে আশোকবাবুর প্রথম সভায় উপস্থিত ছিলেন ঠাকুরমণি লোহার, সুশীলা সিংহ সর্দার, গণেশ সিংহ মুড়ারা। এ দিনও তাঁরা এসেছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, ‘‘উনি এখানে টুসু মেলা শুরু করেছিলেন। মানুষজনকে বড্ড ভালবাসতেন উনি।’’

আশ্রমের কর্মীরা জানান, অশোকবাবু চেয়েছিলেন প্রিয় নেতা নেতাজির চোখের সামনে তিনি থাকতে চান। তাই এ দিন পড়ন্ত বিকেলে গান স্যালুটে সম্মান জানানোর পরে আশ্রম চত্বরে নেতাজির আবক্ষ মূর্তির সামনেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। স্বেচ্ছাবেসক বাহিনীর সদস্যেরাই তাঁর দেহ আশ্রমের মাটিতে শুইয়ে দেন চিরশয্যায়। তুন্তুড়ির বাসিন্দা পিন্টু পরামাণিকের চোখ ভিজে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘‘বড়দের কাছে শুনেছি, আমি যখন খুব ছোট অশোকদা বাড়িতে এসে আমাকে কোলে নিয়েছিলেন।’’ তাই তাঁর দেহ সমাহিত করার সময়ে দেবব্রত বিশ্বাস বলছিলেন, ‘‘অশোকদা তো আর শুধু নেতা ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অভিভাবক। তাই এত ভালবাসা।’’

AshokeGhosh last rites
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy