Advertisement
০১ মে ২০২৪
তোমাদের কাগজ দেখেই...

‘লেসলি ভগবানের মতো বাঁচিয়েছে সুনীতাকে!’

প্রায় ঈশ্বরের মতো হাজির হয়েছিলেন এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী। এভারেস্ট-জয়ী সুনীতা হাজরা তাঁর নাম জানতেন না। কাঠমান্ডুর হাসপাতালে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘কোনও দিন হয়তো আর খুঁজে পাব না। উনি জানবেনও না আমি বেঁচে আছি, এবং ওঁরই জন্য।’’

মেয়ের সঙ্গে লিন্ডসে।

মেয়ের সঙ্গে লিন্ডসে।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

প্রায় ঈশ্বরের মতো হাজির হয়েছিলেন এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী। এভারেস্ট-জয়ী সুনীতা হাজরা তাঁর নাম জানতেন না। কাঠমান্ডুর হাসপাতালে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘কোনও দিন হয়তো আর খুঁজে পাব না। উনি জানবেনও না আমি বেঁচে আছি, এবং ওঁরই জন্য।’’

সুনীতার প্রাণ প্রায় অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছিল এবং প্রায় অলৌকিক ভাবেই সেই ব্রিটিশ অভিযাত্রীর সঙ্গেই যোগাযোগ হয়েছে শনিবার। ফোন মারফত। ভাষা আর দূরত্বের আগল ভেঙে যায় আবেগ আর কৃতজ্ঞতায়। সৌজন্যে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন।

এই কাহিনির মূল চরিত্র অবশ্য সুনীতা নন, এমনকী সেই অভিযাত্রীও নন। গল্পের মোড় ঘুরিয়েছেন ওই অভিযাত্রীর স্ত্রী, লিন্ডসে এম্প্রিংহ্যাম! বিলেতের ইয়র্কশায়ারে বসে।

কী ভাবে? লিন্ডসের মুখ থেকেই শোনা গিয়েছে সেই কাহিনি।

২২ মে প্রায় আট হাজার মিটার উচ্চতায় সাউথ কলের তাঁবু থেকে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে স্ত্রী লিন্ডসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ব্রিটিশ পর্বতারোহী লেসলি জন বিনস। এই পর্বতারোহীই সুনীতার কাছে ঈশ্বরপ্রেরিত দূত। ৪২ বছরের এই ইংরেজ শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘‘এভারেস্ট জয় করতে পারিনি। কিন্তু এক জন ভারতীয় মহিলাকে বাঁচিয়েছি। ডান হাতে ফ্রস্ট বাইট...!’’ এর পরেই কেটে গিয়েছিল ফোন। স্বামীকে আশ্বাস দিয়ে স্ত্রী লিন্ডসে বলতে চেয়েছিলেন, ‘‘শৃঙ্গে ওঠোনি তো কী হয়েছে। তুমি যা করেছো তাতে আমি গর্বিত।’’ বলা হয়নি। স্যাটেলাইট ফোনের এই ঝামেলা! এই আছে, এই কেটে যায়। লিন্ডসের মনটা ছটফট করছিল। পরের দিন স্বামীর খবর পেতে উদগ্রীব লিন্ডসে অভিযান আয়োজক সংস্থার ওয়েবসাইটটা দেখছিলেন। সেখানেই তিনি হঠাৎ দেখতে পান যে, লেসলিদের দলের সকলে শৃঙ্গ ছুঁয়েছেন বলে লেখা রয়েছে সাইটে!

সেটা কী ভাবে সম্ভব? নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে লিন্ডসের মনে। তবে কি লেসলি আগের দিন ফোনে স্রেফ মজা করছিলেন? নাকি ওই মহিলাকে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে পরে আবার শৃঙ্গের পথে পা বাড়িয়েছিলেন? ওই ভারতীয় মহিলারই বা কী হল? ফের ইন্টারনেটের শরণ নিলেন লিন্ডসে। দুর্ঘটনা, ফ্রস্ট বাইট, ভারতীয় মহিলা আরোহী... এ সব শব্দ লিখে খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়ে গেল অজানা ভাষায় লেখা একটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ২৪ মে-র আনন্দবাজার পত্রিকা! প্রথম পাতায় ছবি-সহ সুনীতা হাজরার নিজের মুখে বলা অভিজ্ঞতার কাহিনি!

বাংলা ভাষায় লেখাগুলো বুঝতে পারেননি লিন্ডসে। কিন্তু চোখ আটকে গিয়েছিল সুনীতার ছবিতে! সে ছবিতে সুনীতার ডান হাতে ব্যান্ডেজ! দেখামাত্র লিন্ডসে-র মনে ঝিলিক খেলে যায়! এঁকেই কি তবে বাঁচিয়েছেন তাঁর স্বামী? বর্ণনা অনুযায়ী যাঁর ডান হাতে ফ্রস্ট বাইট! অভিযাত্রীর ঘরণী তিনি। বরফে পোড়া মুখ, ফ্রস্ট বাইটের ব্যান্ডেজ— কোনও কিছুই অচেনা নয় তাঁর।

লিন্ডসে আনন্দবাজারের প্রতিবেদনটি ‘গুগল ট্রান্সলেটর’-এ ফেললেন! পুরোটা বোঝা গেল না অবশ্যই। কিন্তু কয়েকটা লাইন লিন্ডসের মনের অন্ধকার অনেকটা কাটিয়ে দিচ্ছিল— ‘‘খারাপ আবহাওয়ায় আটকে যাওয়া... নিজের অক্সিজেন খুলে লাগিয়ে দেওয়া... ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন এভারেস্ট ছুঁতে... নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম কি? ...মনে নেই... বলা হবে না বেঁচে আছি ওঁর জন্যই...’’— বক্তব্যগুলো টুকরো টুকরো করে নিজের মনে জুড়ে নেন লিন্ডসে। ইতিমধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি স্বামীর সঙ্গে।

যোগাযোগ আবার হল তিন দিন বাদে। ২৫ মে। লেসলি তখন বেসক্যাম্পে নামলেন। সেখান থেকে আবার লিন্ডসের সঙ্গে তাঁর কথা হল। লিন্ডসে স্বামীর কাছে আবার জানতে চাইলেন সেই মেয়েটির কথা, যাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন লেসলি। লেসলি মেসেঞ্জারে জানালেন, ২১ মে সন্ধ্যায় এভারেস্টের পথে রওনা হয়েছিলেন তিনি। রাতে যখন ৮৪০০ মিটার উঁচু ব্যালকনিতে পৌঁছন, তখন দেখেন সেখানে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন এক জন ‘ইন্ডিয়ান লেডি ক্লাইম্বার’। ২১ তারিখ দুপুরে শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফেরার পথে খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়েছেন। ফুরিয়ে গিয়েছে অক্সিজেন। ডান হাতে ফ্রস্ট বাইট। ওই অবস্থায় মেয়েটিকে দেখে আর এগোতে পারেননি লেসলি। সেই রাতে ওই মেয়েটিকে ক্যাম্প ফোরে নিজের টেন্টে ফিরিয়ে এনে সুস্থ করে তোলেন। পরের দিন সকালে তাঁকে পৌঁছে দেন তাঁর (সুনীতার) শেরপাদের কাছে। এর পরে আর লেসলির পক্ষে এভারেস্টে চড়া সম্ভব হয়নি। কারণ, তখন আবহাওয়া খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁর দলের অন্যরা শৃঙ্গ ছুঁলেও তিনি বঞ্চিতই রয়ে গেলেন। বঞ্চিত, কিন্তু একই সঙ্গে ভীষণ ভীষণ গর্বিত!

এ বার লেসলিকে চমকে দিলেন লিন্ডসে। আনন্দবাজারে প্রকাশিত সুনীতার ছবিটা লেসলিকে পাঠালেন। লিখলেন, ‘‘এ রকম একটি মেয়ের কথা ছেপেছে মিডিয়া। সুনীতা হাজরা। তুমি কি এর কথাই বলছিলে?’’ চমকে ওঠেন লেসলি। ‘‘এই তো সেই মেয়ে! সুনীতা!’’ নামটাও মনে ছিল লেসলি-র। অবসন্ন দেহে সুনীতাই বরং লেসলির নাম জেনে নিতে পারেননি। লেসলি এ বার স্ত্রীকে বারবার অনুরোধ করেন, সুনীতার সঙ্গে কথা বলতে! ওঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে।

ফের ইন্টারনেট ঘেঁটে সুনীতার বর্তমান ঠিকানা খুঁজে বার করলেন লিন্ডসে। জানলেন, কাঠমান্ডুর নরভিক ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন সুনীতা। ২৬ তারিখই সেখানে যোগাযোগ করেন লিন্ডসে। সুনীতার সঙ্গে কথা বলতে চান। তবে রাত হয়ে যাওয়ায় কথা বলা সম্ভব হয়নি সে দিন। নিজের নম্বরটি দিয়ে রাখেন তিনি। হাসপাতালে সুনীতার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে এক বিদেশিনির ফোন এসেছে শুনে প্রথমে একটু অবাক হয় সুনীতার পরিবার। পরের দিন তাঁরাই যোগাযোগ করেন লিন্ডসের সঙ্গে। পরিচয় জানতে পেরে বিস্ময় উপচে পড়ে।

সুনীতার সঙ্গেও কথা বলেন লিন্ডসে। সুনীতার পরিবারের তরফে আনন্দবাজারকে জানানো হয় এই রোমাঞ্চকর ঘটনাটি।

এ বার আনন্দবাজারের তরফে লিন্ডসের সঙ্গে যোগাযোগ করার পালা! পরিচয় দিতেই চমকে ওঠেন লিন্ডসে। বিশ্বাস করতে পারেননি, যে প্রতিবেদন দেখার পর এত কিছু ঘটেছে, সেই প্রতিবেদকই যোগাযোগ করেছেন। ‘‘তুমিই লিখেছ, লেসলি ভগবানের মতো বাঁচিয়েছে সুনীতাকে! ইট মেড মি ক্রাই অ্যান্ড শেক! তোমার রিপোর্ট অনুবাদ করেই তো জানতে পারলাম সুনীতার কথা। তোমার দেওয়া ছবিতে সুনীতাকে দেখেই চিনতে পেরেছে লেসলি!’’

লেসলি এখন কোথায়? যোগাযোগ করা গিয়েছে তাঁর সঙ্গেও। প্রতিবেদককে তিনি মেসেঞ্জারে জানিয়েছেন, বেসক্যাম্প থেকে নীচে নামছেন। নামচেবাজারে আছেন। লেসলি জানালেন, তাঁর নিজের লড়াইটার কথাও। ২১ তারিখ রাতে সব রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ছিলেন সুনীতা। আট হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায়, খোলা আকাশের নীচে। বাঁচার লড়াই, ফেরার লড়াই। ঠিক তাঁর পাশেই আর একটা লড়াই চলছিল লেসলির। বাঁচানোর লড়াই, ফেরানোর লড়াই। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এভারেস্টের কোলের কাছে পৌঁছেও শিখর না-ছুঁয়ে ফিরে যাওয়ার লড়াই। শুধু একটা মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। অচেনা, অজানা। একটাই পরিচয়, অভিযাত্রী।

লেসলি বললেন, ‘‘আমি প্রায় শৃঙ্গের কাছে তখন। ব্যালকনি পৌঁছে গিয়েছি। শৃঙ্গ ছোঁয়ার ধকলে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়েছিলেন সুনীতা। অক্সিজেন শেষ। ওকে নিজের অক্সিজেন দিয়ে একটু সুস্থ করার পর জানতে চেয়েছিলাম, নামতে পারবে কি না। ও নামতে শুরুও করেছিল। কিন্তু ওর পা ফেলা দেখেই আমি বুঝেছিলাম, এ ভাবে একা ছাড়া যাবে না ওকে। তখনই নিজের শেরপাকে বলি, আর এগোব না। সিদ্ধান্ত নিই, সামিট থাক। একে ফেরানো জরুরি।’’

বর্ণনা দিলেন, কী ভাবে এক-পা এক-পা করে সুনীতাকে নামিয়েছেন তিনি। জানালেন, তিনি নিজেও কতটা অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কী ভাবে নিজের কোমরের ‘সেফটি রোপ’-এর সঙ্গে সুনীতাকেও বেঁধে নেন, পাছে পড়ে যান সুনীতা। জানালেন, কী ভাবে পার করেন বিপজ্জনক নীল বরফের ঢাল (শক্ত ব্লু আইস, তুষার গাঁইতি বা জুতোর তলায় লাগানো কাঁটা গেঁথে সাপোর্ট নেওয়া যায় না)। প্রতিটা মুহূর্তে পা পিছলে যাচ্ছিল। ‘‘এত অসহায় লাগছিল, চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। মাঝে মাঝে মেজাজ হারিয়ে ফেলছিলাম সুনীতার ওপর। কিন্তু পর ক্ষণেই বুঝতে পারছিলাম, শেষ জীবনীশক্তি দিয়ে বাঘের মতো লড়াই করছে ও।

শি ফট লাইক আ টাইগার।’’ — বললেন লেসলি।

আর সব শেষে জানালেন, আজ আমি ভীষণ গর্বিত। এক জন মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে বড় সম্মান আর কোনও শৃঙ্গ জয় করেই পেতে পারেন না মানুষ। বললেন, ‘‘সুনীতাকে বোলো, এক মুহূর্তের জন্যও ওর জন্য প্রার্থনা করা বন্ধ করিনি আমি।’’

এ হেন একটা মানুষের জীবনসঙ্গী হতে পারার গর্বটাও তো বড় কম নয়! লিন্ডসের মুখ থেকে জানা গেল, ওঁদের স্কুলজীবনের পরিচয় ‘এনগেজড’ তকমা পেয়েছিল ২০১৪ সালে। বরাবরই এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতেন লেসলি। একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার তরফে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইরাকে মোতায়েন ছিলেন। ল্যান্ডমাইনের আঘাতে হারিয়েছিলেন একটি চোখ।

ইরাক থেকেই এপ্রিলে পাড়ি দেন কাঠমান্ডু। দুশ্চিন্তার প্রহর গুনছিলেন ৪১ বছরের লিন্ডসে— ‘‘ইন্টারনেটে তোমার পাতাটা যখন খুলল, এক বর্ণও বুঝতে পারিনি। শুধু বরফে পুড়ে যাওয়া মেয়েটার মুখ দেখেছিলাম। এই পুড়ে যাওয়া আমার চেনা। লেসলিও এ ভাবেই ফিরত ওর সব অভিযান থেকে। সেই সঙ্গে দেখলাম, মেয়েটির ডান হাতে ব্যান্ডেজ!’’

মাঝে মাঝেই উঠে যাচ্ছিলেন, দু’বছরের ছোট্ট মেয়েকে সামলাতে। তাঁর কথায় বারবার ফুটে বেরোচ্ছিল লেসলির মতো অভিযাত্রীর স্ত্রী হওয়ার গর্ব। এমন এক জন অভিযাত্রী, যাঁর সম্পর্কে লিন্ডসে বলতে পারেন, ‘‘কেউ বিপদে পড়লে তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর দৌড় ওর জন্য নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE