Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

কেউ আসে না, ভাঙা মনে ভোটে ‘শ্যাডো জ়োন’

মাটির বাড়ির দেওয়ালে উজ্বল শুধু গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার। আর মোড়ে মোড়ে উড়ছে আদিবাসী সমাজের হলুদ-সবুজ পতাকা। এ যে ভোট-ভূমেও ‘শ্যাডো জ়োন’!

দেওয়ালে এখনও গত পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

দেওয়ালে এখনও গত পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য
বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ১০:৩১
Share: Save:

চার, তিন, দুই, এক...

কমতে কমতে একেবারে মিলিয়েই গেল মোবাইল স্ক্রিনে নেটওয়ার্ক নির্দেশক দাগগুলো। গাড়ির চালক জানালেন, ‘শ্যাডো জ়োন’ শুরু। ১২ কিলোমিটার আর মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যাবে না।

বেলপাহাড়ি চক পেরিয়ে এসেছি। দু’পাশে মাথা উঁচু পাহাড় আর শাল-মহুয়ার জঙ্গল চিরে ঝাড়খণ্ড সীমানার দিকে কিছুটা এগোতেই নজরে এল ঘরবাড়ি। ঢুকে পড়লাম মাটি লেপা দেওয়াল, নিকোনো উঠোনের আদিবাসী গ্রাম জামাইমারিতে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দোরগোড়ায় লোকসভা ভোট। ঘাসফুল আর পদ্মের টক্কর মালুম হচ্ছে ঝাড়গ্রাম জেলা জুড়ে যুযুধানের প্রচারে। সভা করতে আসার কথা খোদ প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তো বেলপাহাড়িতেই সভা করার কথা। অথচ বেলপাহাড়িরই এ তল্লাটে ভোট প্রচারের নামগন্ধ নেই। ভোটার হাজার খানেক। তবু কোনও দলের প্রচার লিখন নেই, নেই পতাকা। মাটির বাড়ির দেওয়ালে উজ্বল শুধু গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার। আর মোড়ে মোড়ে উড়ছে আদিবাসী সমাজের হলুদ-সবুজ পতাকা।

এ যে ভোট-ভূমেও ‘শ্যাডো জ়োন’!

গ্রামের শেষ মাথায় এক চিলতে চা দোকান চালান অক্ষয় নায়েক। অলচিকিতে স্নাতক এই যুবক বললেন, ‘‘ভোটের আগে হোক বা পরে, আমাদের কাছে কেউ আসে না।’’ কোনও দলের প্রচার হয়নি গ্রামে? মাথা নাড়লেন অক্ষয়, ‘‘এক জন প্রার্থীকেও চোখ দেখিনি। বিজেপির কার্যকর্তারা শিমূলপালের দিকটায় এসেছিলেন বলে শুনেছি।’’ চা বানানোর ফাঁকে জুড়লেন, ‘‘পড়াশোনা করে বসে আছি। আর টাকা দিয়ে সব টিচার হয়ে যাচ্ছে। সিভিকের চাকরিতেও টাকার খেলা।’’

ইতিউতি ক্ষোভ আরও। প্রাথমিক স্কুলের চাল ভাঙা, সেচের জল মেলে না, কেউ বাড়ি পাননি, কারও অনুযোগ— ভাতার টাকা কেটে নিয়েছে। তবে সব ছাপিয়ে একটাই স্বর, ‘আমাদের গ্রামে কেউ আসে না।’ প্রদীপ মুর্মু, মহাদেব নায়েকরা বললেন, ‘‘গত বারের সাংসদ তো পাঁচ বছরে একটি বার আসার সময় পাননি।’’

টুকরো টুকরো এই সব ক্ষোভই বিনি সুতোর মালার মতো গাঁথা হয়ে সামনে এসেছিল গত পঞ্চায়েত ভোটে। জামাইমারি-সহ শিমূলপালের গ্রামগুলোতে তৈরি হয়েছিল আদিবাসীদের অরাজনৈতিক যৌথ মঞ্চ। মঞ্চের প্রার্থীকে ঢেলে ভোট দিয়েছিল গ্রামবাসী। শিমূলপাল পঞ্চায়েত দখল করেছিল মঞ্চই।

লোকসভার আগে হিসেব পাল্টেছে। আদিবাসী সমাজের নেতা রবিন মুর্মুর স্ত্রী বিরবাহা সরেন ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে শাসকদলের প্রার্থী হওয়ায় সমাজের একাংশ খেপেছেন। মঞ্চও ভেঙে গিয়েছে। মুন্ডা সমাজ আলাদা প্রার্থী দিয়েছে। এ সব অজানা নয় জামাইমারির বাসিন্দাদের। তাঁরা বলছেন, ‘‘যা চলছে, আমাদের মন ভেঙে গিয়েছে।’’

এক সময় মাওবাদীদের খাসতালুক বেলপাহাড়ির এই তল্লাটে এমন প্রবণতা বিপজ্জনক, বলছেন এলাকারই বাসিন্দা কংগ্রেসের জেলা সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য। প্রবীণ এই নেতার মতে, ‘‘এটা আমাদের মতো মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা। এতে যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, তাতেই তো রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি জনভিত্তি পায়।’’ মমতার সভার প্রস্তুতিতে শিলদায় গিয়েছিলেন তৃণমূলের ঝাড়গ্রাম জেলার আহ্বায়ক উজ্জ্বল দত্ত। তিনি বললেন, ‘‘শিমূলপালের দিকটায় আমাদের কিছু পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। আসলে ও সব জায়গায় সচেতন কর্মীর ঘাটতি রয়েছে।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি সুখময় শতপথীর আবার দাবি, ক’দিনের মধ্যেই প্রার্থী যাবেন।

এলাকায় যাবেন বলে জানালেন আদিবাসীদের সর্বোচ্চ সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের প্রধান নিত্যানন্দ হেমব্রমও। তাঁর কথায়, ‘‘ভোট নিয়ে কিছু লোক ভুল বুঝছে। আমি গিয়ে বোঝাব।’’

জামাইমারিও বোঝে উপেক্ষার জবাব দেওয়া যায় ইভিএমেই। ছেলে-বুড়োর দল তাই দিন গুনছে— এক, দুই, তিন, চার...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE