খেজুরির রামচক গ্রামে প্রয়াত সাংসদ বসন্তকুমার দাসের তৈরি মাটির বাড়ি। নিজস্ব চিত্র
উজ্জ্বল অতীত নিয়ে এখনও গর্ববোধ করেন জেলার মানুষ। অবিভক্ত মেদিনীপুরে বিপ্লবী, শিক্ষাবিদ, শিল্পপতি থেকে রাজনীতিক—কে নেই সেই তালিকায়! এঁদের অনেকের স্মৃতি রক্ষায় বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপও করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর পর্বে ভারতীয় সংবিধান রচনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তথা কাঁথি মহকুমার প্রথম সাংসদ বসন্তকুমার দাস-এর বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাব নিয়ে অভিযোগ রয়েছে জেলায়।
২০০২ সালে মেদিনীপুর জেলা পূর্ব ও পশ্চিম-এ ভাগ হয়। নয়া পরিচিতি পেয়ে জেলাবাসী ভেবেছিলেন প্রয়াত এই রাজনীতিকের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে পদক্ষেপ করা হবে। যা নিয়ে দাবিও উঠেছে একাধিকবার। স্বাধীনতার পরে এক বার নয়, দু’দুবার কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের হয়ে ভোটযুদ্ধে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন বসন্তবাবু। ১৮৯৮ সালের ১ মার্চ জন্ম। খেজুরি-২ ব্লকের রামচক গ্রামে তাঁর বসতভিটে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ কংগ্রেসের প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। নিজেরই শিক্ষক প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। এর পর ফের ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কাঁথির সাংসদ হন খেজুরির এই কৃতী সন্তান। সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাস, মানুষের পাশে থাকার তাঁর ব্রতকে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন জেলার বহু প্রবীণ। বর্তমান রাজনীতির কলুষতার দিকে আঙুল তুলে আদর্শ রাজনীতিক হিসাবে তাঁরা এখনও বসন্তবাবুর উদাহরণ টেনে আনেন।
‘রাজনীতিতে টাকাই সব। বিধায়ক, সাংসদ হতে পারলে আর চিন্তা নেই’ এমন মন্তব্য এখন আকছার শোনা যায়। বিশেষ করে ভোট এলে রাজনীতিকদের নিয়ে সাধারণের সেই ক্ষোভ আরও বাড়ে। আলোচনা হয় বিধায়ক, সাংসদের ক্রমবর্ধমান সম্পত্তির খতিয়ান নিয়ে। কিন্তু খেজুরির রামচকের পর্ণ কুটির যেন সেই ধারণাকে প্রতিপদে চাবুক মারতে থাকে। দু’দুবারের সাংসদের মাটির দেওয়ালের বাড়িতে আজও টালি আর খড়ের ছাউনি। মাটির দাওয়ায় উঁকি মারে বসার জন্য কাঠের চৌকি। কালচে হয়ে যাওয়া খড়ের রং জানান দেয় দীর্ঘদিন ঘর ছাওয়া হয়নি। বাড়ির পরতে পরতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু স্মৃতি। মাটির দেওয়ালে ফ্রেমবন্দি প্রয়াত সাংসদের সস্ত্রীক ছবি। এই পর্ণকুটির নিজেই বানিয়ে ছিলেন বসন্তবাবু।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
দাদা ক্ষীরোদচন্দ্র দাস ছিলেন খেজুরির প্রথম গ্র্যাজুয়েট। বসন্তবাবুর স্ত্রী তরঙ্গিনীদেবী ছিলেন খেজুরির নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বামী-স্ত্রীর জেলাস্তরে নেতৃত্বের স্মৃতি হিসেবে রামচক বাসস্ট্যান্ডে এবং খেজুরি আদর্শ বিদ্যাপীঠে বসন্তবাবুর আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। এই বিদ্যালয়ের রূপকারও বলা হয় তাঁকে। খেজুরির এই মাটির বাড়িতে বসেই তিনি মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর দু’টি বই লিখেছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১ ডিসেম্বর বসন্তবাবুর মৃত্যু হয়। এরপর ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল বসন্তবাবুর বড় ছেলে পরেশকান্তি দাস বাংলা কংগ্রেসের বিধায়ক হয়েছিলেন। নেই তিনিও। বসন্তবাবুর নাতি সজলকান্তি দাস স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে রামচকের এই বাড়িতেই বাস করেন। আজও গোটা বাড়িতে উত্তরসূরীদের আর্থিক দৈন্যতার ছায়া।
ফ্রেমবন্দি বসন্তকুমার ও তরঙ্গিনী দেবী।
সজলবাবুর দাবি, “বসন্তবাবুর পাশাপাশি খেজুরির স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি রক্ষায় ওই বাড়িতেই একটি সংগ্রহশালা করা হোক।’’ খেজুরির বাসিন্দা আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সুদর্শন সেন বলেন, “ওই বাড়িতে এখনও বহু দুষ্প্রাপ্য বই, ছবি ও নানা তথ্য, স্মৃতি রয়েছে। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর পদধূলি পড়েছে এখানে। এমন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বাড়িটি সংরক্ষণ করা উচিত।’’
১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় বসন্তবাবুর হয়ে প্রচার করেছিলেন প্রবীণ কংগ্রেসী ও কাঁথির বাসিন্দা শৈলজা দাস। তাঁর কথায়, ‘‘টিনের চোঙা নিয়ে গ্রামে গ্রামে সেই প্রচার বিফলে যায়নি। বসন্তবাবু সেবার জিতেছিলেন। কাঁথির এই স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রণম্য ও শ্রদ্ধেয়। তাঁর খেজুরির বাড়ি সংরক্ষণের দাবি সঙ্গত।’’
এক সময় কংগ্রেসে থাকলেও বর্তমানে তৃণমূলের বিদায়ী সাংসদ। তৃণমূলের হয়ে দু’দুবার সাংসদ হয়েছেন তিনিও। এ বারও লড়ছেন লোকসভা নিবার্চনে প্রার্থী শিশির অধিকারী। তাঁর কথায়, ‘‘বসন্তবাবু কাঁথি মহকুমার অন্যতম কৃতী সন্তান ছিলেন। তবে তাঁর বসতভিটে সংরক্ষণের দাবি নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। কারণ এখন নির্বাচনের আদর্শ আচরণ বিধি চালু রয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy