Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

গানের গুঁতো বা মিঠেকড়া গ্ল্যামার-আবেশ

বাবুল সুপ্রিয় সেটা স্বীকারও করছেন। ‘‘কী করব, ছেলেরা রাগলেও এটাই আমার স্টাইল!’’ থিম সং থেকে মাইকের প্রচার— সবই রেডি করে পেনড্রাইভে ভরে দিয়েছেন।

তারকা প্রার্থীরা। —নিজস্ব চিত্র।

তারকা প্রার্থীরা। —নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১৩
Share: Save:

প্রোডাকশন ইউনিট একটা আছে ঠিকই! তবে তিনি বাদে সবই ‘একস্ট্রা’।

লোকেশনে এসে মালুম হল, এ ছবির নায়ক-গায়ক তো বটেই, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, ফ্যাশন ডিজ়াইনার, প্রোডাকশন কন্ট্রোলার— সবই শুধু তিনি। আসানসোলের কালীপাহাড়ি মোড় থেকে জুবিলি পাম্প মোড় পেরিয়ে গৌরাংডির পথে বহুমুখী চরিত্রটির সঙ্গে দেখা হল। তখন তিনি অসম্ভব মনোযোগে নিজের গাড়ির গায়ে গেরুয়া পতাকা বাঁধছেন। প্রচার-গাড়ির দু’ধারে দু’টো চোঙার গায়ে দলের পতাকা বসানো থেকে ওআরএস-আমপান্নার বোতলগুলো রাখার বাক্স সাজানো— সব কিছুতে অসম্ভব খুঁতখুঁতে তিনি।

বাবুল সুপ্রিয় সেটা স্বীকারও করছেন। ‘‘কী করব, ছেলেরা রাগলেও এটাই আমার স্টাইল!’’ থিম সং থেকে মাইকের প্রচার— সবই রেডি করে পেনড্রাইভে ভরে দিয়েছেন। প্রচারের জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ এ বারও নিজে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। রোড-শোয়ের কনভয়ে পরপর কী থাকবে, সব চিত্রনাট্যমাফিক। সামনে বাবুলের ছবি মোড়া মিনিডরটা ‘গানের গাড়ি’! তাতে ‘বিতর্কিত’ ‘এই তৃণমূল আর না’ বাজছে। তার পরে বাইক-বাহিনী। মাঝামাঝি থাকা মিনিডরটিতে সশস্ত্র সিআরপি-সহ প্রার্থীর অবস্থান। পিছনে তাঁর ব্যক্তিগত এসইউভি। এবং আসানসোল শহরের সাঙ্গোপাঙ্গদের গাড়ির লাইন। লক্ষণীয় ভাবে, ত্রিসীমানায় কোনও মহিলা নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল বললেন, ‘‘প্রচারের পরে কী খাওয়া হবে, সেটা দলের মহিলা মোর্চার সঙ্গে আমার স্ত্রী দেখছেন।’’

খনিতে ফুটিফাটা শিল্পাঞ্চলে পুরুষপুঙ্গবদের মিছিলময় আগ্রাসী ‘মর্দানি’র হুঙ্কার। প্রচার-গাড়িতে দাঁড়িয়েই ‘‘থানার ওসি কে আছেন?’’ বলে প্রার্থী হাঁক পাড়লেন। তটস্থ পুলিশ অফিসারটির প্রতি পরের সংলাপ: ‘‘কী হল, মন্ত্রী মলয় ঘটক ডাকলে যে ভাবে আসেন, সে ভাবে আসুন!’’ বাইক-বাহিনীর অট্টহাসি। পুলিশকে চ্যালেঞ্জের সুরে মিছিলে হামলার শঙ্কা নিয়ে সতর্ক করা হল। মধ্যমণি সহাস্য বাবুল। গরমে রেক্সিনের ঢলঢলে জুতো থেকে ‘নমো আগেন’ লেখা গেরুয়া টুপি— তাঁর সর্বাঙ্গেও পরিকল্পনার ছাপ। সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে পদ্মফুল-ছাপ ওড়না, মায় গেরুয়া ব্যান্ডের রিস্টওয়াচটি পর্যন্ত ভোটবার্তায় সরব। সাদা পাঞ্জাবিটা ঘামে লেপ্টে। গাড়িতে হ্যাঙারে আর এক পিস ঝুলছে চোখে পড়ল।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দক্ষিণ ভারতের তারকাতন্ত্রের জগঝম্প, অতিলৌকিক আড়ম্বর না-থাকুক, নাটকীয় উপাদানে বাংলার তারকাদের ভোটও নেহাত কম যাবে না। ঘাটালে দেবের সভাতেও একটা ফিল্মি আমেজ রাখার চেষ্টা করছে তৃণমূল। নায়কের আবির্ভাবকে জমজমাট করে তুলতে দেড় মিনিটের ‘র‌্যাপ’ বারবার বাজছে। তাতে দিদি-র উন্নয়নের মহিমা থেকে ‘দীপক অধিকারী’-কে ভোটের আর্জি— রয়েছে সবই! পাঁচ বছর আগের তুলনায় দেবও এ বার খানিকটা বলিয়ে-কইয়ে! কিন্তু প্রতিপক্ষকে বিঁধে বাক্যবাণ ছোড়ার সংস্কৃতি এখনও রপ্ত করতে পারেননি। চোখা-চোখা ফিল্মি সংলাপের স্বাদ পেতে তাই আসানসোলই লা-জবাব!

‘‘আমি মোদীজির চৌকিদার’’ বলে কয়লা-মাফিয়া, বালি-মাফিয়া বা তৃণমূলের মেজ-সেজ নেতাদের সঙ্গে যেন অদৃশ্য অসিযুদ্ধের মহড়া দিচ্ছেন বাবুল। শাসক দলও এই রুটের বাঁকে বাঁকে ‘‘চৌকিদার চোর হ্যায়’’ পোস্টার বসিয়েছে। দেখে আরও উত্তেজিত বাবুল। মফস্‌সলি গঞ্জ-বাজারের জনতার জন্য ‘পয়সা উসুল’! ‘শটের’ বিরতিতে জনৈক সহকারীর এনে দেওয়া লোশন-জলে তুলো ভিজিয়ে মুখের কালি ঘষে তুলছেন বাবুল।

নিজে ভারসাম্য বজায় রাখলেও তারকাদের এই আগ্রাসী ‘জঙ্গি’ প্রচারকে দোষ দিতে চান না দেব। পাঁশকুড়ায় সভার ফাঁকে মধ্যাহ্নভোজ-পর্বে বলছিলেন, ‘‘এখন কিন্তু সবাই অভিনেতা! তারকাদের থেকে রাজনৈতিক নেতারাও কম যান না।’’ ভাইরাল ভিডিয়ো সাক্ষী, বীরভূমে গত লোকসভা ভোটে শতাব্দী রায় সটান ‘‘আমায় ফ্রি-তে দেখছ তাই ভোট চাইছি’’-বলে আর্জি জানিয়েছিলেন। কোনও কোনও মহলে এর নিন্দা হলেও শতাব্দীর ব্যাখ্যা, ‘‘সিরিয়াস প্রচারের সময়ে মজা করে দু’-চারটে কথাও বলতে হয়! আর ভোটাররা যে কিছু মনে করেননি, তা-ও ভিডিয়োয় জনতার হাততালি-উচ্ছ্বাসেই স্পষ্ট।’’

তৃতীয় বার সাংসদ হওয়ার লড়াইয়ে থাকা শতাব্দী কিন্তু ক্রমেই তারকা থেকে রাজনীতির মানুষ হয়ে উঠেছেন। বললেনও, ‘‘গত বছর নিজের কেন্দ্রে যাত্রা করার সময়ে স্কার্ট-জিন্‌স পরতে অস্বস্তিই হচ্ছিল আমার!’’ রুপোলি পর্দার ইমেজ ঝেড়ে ফেলার ক্ষেত্রে বিজেপির মহিলা মোর্চার নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ও মোক্ষম উদাহরণ। হুগলির প্রার্থী ঝাঁঝালো বক্তা হিসেবে হাততালি কুড়োচ্ছেন। উস্কোখুস্কো খোঁপায় তারকাসুলভ হাবভাব উধাও। বাবুলের মতো লকেটও ভোট-প্রচারের যাবতীয় ঘুঁটি নিজেই সাজাচ্ছেন। মৃদু হেসেই বললেন, ‘‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কলিগরা এখন প্রকাশ্যে আমার ফেসবুকের ছবিতে লাইক পর্যন্ত দেন না!’’

প্রচারের ঝক্কিতে ধূলিধূসরিত তারকার ভিড়ে সেই রাশভারী তারকাসুলভ ঝাঁঝটাই কি তবে উবে যেতে বসেছে? আসানসোলের চারতারা হোটেলের লবিতে মুনমুন সেনের সঙ্গে দেখা হতে সংশয়ের অবসান। স্থানীয় নেতা ভি শিবদাসানি থেকে দলের পর্যবেক্ষক কর্নেল দীপ্তাংশু চৌধুরী— কম-বেশি ‘ম্যাডাম’-এর মিঠে-কড়া মেজাজ টের পাচ্ছেন। ‘‘শোনো, সব গ্রামে আমি ঢুকতে পারব না’’ কিংবা ‘‘বড় মিটিং অর্গানাইজ় করো একটু’’ থেকে ‘‘শুধু মিষ্টি করে হাসলে চলবে না’’— কথাগুলো বাজছে মুনমুন সেনসুলভ ভঙ্গিতে। তিনি হাত ধরে ‘‘দেখো গোলমাল যেন না-হয়’’— বলার মুহূর্তে বিগলিত আসানসোলের পুরনেতা।

গুটিগুটি সভায় ঢুকে সুচিত্রা সেন-কন্যা বলছেন, ‘‘রেডিয়োয় গান শোনো কাজের ফাঁকে, কিন্তু প্লিজ় গানকে ভোট দিয়ো না!’’ বাঁকুড়ায় পাঁচ বছর আগের যুদ্ধজয়েও ঠিক এমনই ছিলেন মুনমুন। তিনি কতটা দলে মিশ খেলেন, আর কতটা তারকা থাকলেন, জিতলে এ সব চুলচেরা বিচার দল করবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE