Advertisement
১১ মে ২০২৪

ঘরের লোক থেকে বাঁচাবে কে

স্বামী কথায় কথায় বলে, ‘‘তোমাকে পছন্দ না!’’ ও দিকে ফতিমা টের পান, চাচাতো বোনের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। তা হলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? প্রশ্ন করলেই মারধর।

জীবনের যুদ্ধে দুই কন্যা। নিজস্ব চিত্র

জীবনের যুদ্ধে দুই কন্যা। নিজস্ব চিত্র

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
হাসনাবাদ শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০৫:০০
Share: Save:

ঝড় আসছে শুনেই মাটির উনুনটা প্লাস্টিক চাপা দিয়ে তার উপরে পাথর চাপিয়েছেন ফতিমা (নাম পরিবর্তিত)। ঝুপড়ি ঘর সরকারি সাহায্যে পাকা হয়েছে। কিন্তু দু’টো ঘর তুলে ছাদটা পাকা করার পয়সা আর ছিল না। ঝড়ের খবর শোনামাত্র দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাই। সেই সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে আয়লার কথা।

হাসনাবাদের আমরুলগাছা গ্রামের মেয়ে ফতিমার কাহিনি ঠিক আয়লা-বিপর্যস্তের কাহিনি নয়। কিন্তু জীবনে কখনও স্কুলে না যাওয়া ফতিমা কথা বলতে বসলে সময়-নির্দেশ করার ওই একটাই রেফারেন্স খুঁজে পান। কখন ফিরে এলেন বাপের বাড়ি? আপনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কখন? তালাক কবে বলল? ছেলে কখন জন্মাল?

ভিতরের আর বাইরের ঝড় মিশে যায়। উত্তর আসে, ওই আয়লার সময়!

অনটনের সংসারে চোদ্দো বছরের ফতিমার একটা সম্বন্ধ এসেছিল। পাত্রপক্ষ দেখতে এসে সেদিনই পছন্দ করল, বিয়ে করে নিয়েও গেল। শ্বশুরবাড়ি মছলন্দপুরের সলুয়া। ফতিমা গিয়ে দেখেন, স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর একটি এক মাসের শিশুপুত্র আছে। সেই স্ত্রী কোথায়? গ্রামের লোকেই জানাল, অন্তঃসত্ত্বা বধূ পেটে ব্যথা করছে বলাতে স্বামীর মনে হয়েছিল, ‘যত্ত নাটক!’ সে কষিয়ে মারল এক লাথি। মেয়েটি মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে জীবিত সন্তানটিকে বের করে আনলেন ডাক্তার। মাকে বাঁচানো গেল না।

এ হেন সংসারেই ঠাঁই হল ফতিমার। স্বামী কথায় কথায় বলে, ‘‘তোমাকে পছন্দ না!’’ ও দিকে ফতিমা টের পান, চাচাতো বোনের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। তা হলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? প্রশ্ন করলেই মারধর। পড়ে পড়ে মার খাওয়াই জীবন। বছর পাঁচ-সাত এমনি করে কেটে গেল। মারধরের মাত্রা খুব বেশি হলে মনে হত বাপের বাড়ির কথা। কিন্তু সেখানেও তো দারিদ্র। বিয়ে হওয়া মেয়ে ফিরে আসা মানে ভার বাড়ানো! ফতিমা সয়ে যাচ্ছিলেন। আয়লার সময় ভাঙন আর ঠেকানো গেল না। চারদিকে তছনছ অবস্থা। ফতিমা নিজে গর্ভবতী। সেই অবস্থায় অশান্তি চরমে উঠল। মার খেতে খেতে অচৈতন্যপ্রায় ফতিমা শুনতে পেলেন স্বামী ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের লোকেরা ফতিমাকে তুলে হাড়োয়া হাসপাতালে নিয়ে গেল। ফতিমা আর ফেরেননি সলুয়াতে। প্রতিবন্ধী পুত্রসন্তানকে নিয়ে নিজের গ্রামেই আছেন। শোনা যায়, চাচাতো বোনকে বিয়ে করে তাঁর স্বামী আবার সংসার পেতেছে।

তাৎক্ষণিক তিন তালাক এখন বেআইনি, জানেন? না, ফতিমা জানেন না। আইনকানুনের জটিলতা বোঝার সামর্থ্য আর সুযোগ, মামলা লড়ার ক্ষমতা কোনওটাই তাঁর নেই।

ফতিমার দাওয়াতেই মাদুরের ও পাশে বসে আছেন শবনম (নাম পরিবর্তিত)। আর আছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে শাকিলা আর জুলেখা খাতুন। শবনমেরও এ গ্রামেই বাড়ি। শবনমকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল। কিছু দিন পর কোনও ক্রমে পালিয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। কিন্তু এটা শবনমের জীবনের ভূমিকা মাত্র। তাঁর দুঃস্বপ্নের পরের পর্বটা ইছামতীর ধারে অপেক্ষা করছিল। শবনম ফিরে এসে দেখলেন, পাচারকারী লোকটির মনে ভয় ঢুকেছে। যদি পুলিশে দেওয়া হয়! সে কাগজের চিরকুটে শবনমের নামে কুৎসা লিখে গ্রামে ছড়াতে লাগল। বাধ্য হয়ে শবনম আপসে এলেন, ওই পাচারকারীকেই বিয়ে করলেন।

বিয়ের পর? ‘‘আমি বিড়ি বেঁধে যা রোজগার করতাম, তাই দিয়েই আমার চলত। একটা পয়সা ঠেকাত না। দু’দিন অন্তর বাবার কাছ থেকে টাকা আনতে বলত। রাজি না হলেই মার। একদিন আমার বাবার সামনেই এমন মারল, আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। বাবা জমি বন্ধক দিয়ে দশ হাজার টাকা দিল। টাকা দিলেই বা কী? সে তো জুয়ো খেলে উড়িয়ে দেয়। আর একটা মেয়ে আছে, তার সঙ্গে গিয়ে থাকে। কত বার টাকা দেব? মারধর করে বলে ওর নামে মামলা করেছিলাম। তখন বলল, সংসার করব। মামলা তুলে নাও। আমি রাজি হইনি। আগে সংসারে মন দিক, তবে তো! দু’মাস গিয়ে থাকলাম। তার পর আবার মারধর। রড দিয়ে এমন সব জায়গায় মারল, দেখাতে পারব না দিদি। শরীরের ভিতরেও মেরেছে, কী অসহ্য কষ্ট! আমি পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। ডাক্তারি পরীক্ষা হল, এফআইআর হল। এমন কপাল আমার, ওদের উকিল আমার উকিলকে টাকা খাইয়ে ‘জেরক্স’ করার নাম করে আমার সব কাগজপত্র হাতিয়ে নিল। এখন নতুন উকিল যদি কিছু করতে পারে! ছেলেকে নিয়ে গত বছর সেই যে চলে এসেছি, আর যাইনি।’’

রিজেন্ট পার্কের নন্দিনী সাহু, বাগদার তনয়া মণ্ডল, মুর্শিদাবাদের সুমিত্রা কুন্ডু, লিলুয়ার সুপর্ণা জানা, তমলুকের রঞ্জনা অধিকারী, কুলপির রোশেনারা বিবি...পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয় এটা, সামান্য কয়েকটা নাম মাত্র। এঁরা প্রত্যেকে পণের জন্য অত্যাচারে আর গার্হস্থ্য হিংসার কবলে প্রাণ হারিয়েছেন সাম্প্রতিক কালে। এ রাজ্যে।

যাঁরা খুন হয়ে গিয়েছেন, তাঁরা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাঁরা প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছেন বা এখনও দাঁত চেপে সহ্য করে চলেছেন, তাঁদের সংখ্যা কে গোনে! মেয়েদের নিজেদের কথাতেই পরিষ্কার, অনেকেই পালাতে পারেন না, বাপের বাড়ির দারিদ্রের কথা ভেবে। যাদের সে সমস্যা কম, সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সুবিধা হয় তাঁদের। মহিষপুকুর গ্রামের রীনা পারভীনের বাড়ির অবস্থা যেমন তুলনায় ভাল। তাঁর স্বামীই ছিল বেকার। রীনাকে তার দরকার ছিল পয়সার জন্য। বেশ কিছু দিন সহ্য করার পরে প্রতিবাদ করায় তালাকের কথা উঠল। দুই পরিবার রফায় এসে রীনার তালাক হল। মাধ্যমিক পাশ রীনা এখন বিড়ি বেঁধে নিজেরটা চালিয়ে নিচ্ছেন। ভাইয়েরা আলাদা ঘর তুলে দিয়েছেন। সুখ না হোক, শান্তিটুকু আছে। তবু রীনার মন খিচখিচ করে, ‘‘আমি নিজে যদি স্বাধীন ভাবে তালাক নিতাম, ভাল হত। সকলের মিলিত সিদ্ধান্তে আমার তালাক নির্ধারিত হল, এটা যেন কেমন!’’

ফতিমা, শবনম, রীনা। আশ্চর্য হতে হয় ওঁদের দেখে। বিশেষ করে প্রথম দু’জন। এই ভয়াবহ জীবন যুঝেও মুখের হাসি উবে যায়নি। বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকার ফুরসতও ওঁদের নেই। তার মধ্যেই পাটলিখানপুরে যেদিন নুসরত জহান প্রচারে এলেন, দল বেঁধে দেখতে গিয়েছিলেন সবাই। ‘‘হেব্বি সুন্দর চুল!’’ ফতিমাদের গলায় ঝলকে ওঠে মেয়েলি খুশির দমক। নাগরিক উন্নাসিকতা কী করে মাপবে এই উচ্ছ্বাসের দাম?

মেঘের রং ঘোরালো। ফেরার পথ ধরতে হবে। তিন কন্যা আকাশ থেকে পড়েন, ‘‘আজকের দিনটা থেকে যাবেন না, ও দিদি?’’

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE