বুধবার ৭ রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি পিআইবি-র সৌজন্যে।
আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক কেন্দ্র-রাজ্যের ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’। এর পিছনে রাজনীতি নেই। কার্যক্ষেত্রেও যেন তা প্রমাণ করতে চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতায় যে দিন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তাঁকে তীব্র কটাক্ষে বিঁধলেন, সেই দিনই ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে বসলেন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে। বন্যাত্রাণ থেকে শুরু করে ছিটমহলের পরিকাঠামো উন্নয়ন— কেন্দ্রের সাহায্য চাইলেন সব ক্ষেত্রেই। নীতি আয়োগের বৈঠক সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। অথচ গোড়া থেকেই এই নীতি আয়োগের বৈঠক ‘জেদের বশে’ এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠত মমতার বিরুদ্ধে।
মোদীর সঙ্গে বৈঠকে তাঁর হাতে আজ দু’টি চিঠি তুলে দেন মমতা। তার মধ্যে তেরো পাতার একটি চিঠি শুধুই বন্যা সংক্রান্ত। ওই চিঠিতে পশ্চিমবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতিকে ‘আপৎকালীন বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন মমতা। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানিয়েছেন, ১২টি জেলার প্রায় ১ কোটি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। নষ্ট হয়েছে ১২ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি। এই বিপুল ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় সাহায্য চেয়ে দরবার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বন্যাত্রাণ এবং পুনর্বাসনের প্রশ্নে ২১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছি। তিনি এ ব্যাপারে শীঘ্রই পদক্ষেপ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।’’
অন্য একটি চিঠিটিতে রাজ্যের অন্যান্য সমস্যা ও দাবিদাওয়া তুলে ধরেছেন মমতা। যার মধ্যে রয়েছে ছিটমহল এলাকার পরিকাঠামো এবং পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত মঞ্জুর করা, বকেয়া কেন্দ্রীয় আর্থিক প্যাকেজ মিটিয়ে দেওয়া, নীতি আয়োগে রাজ্যের ভূমিকা বাড়ানোর মতো দাবিগুলি। এ ছাড়া দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের আধুনিকীকরণ, ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান এবং নেপালের মধ্যে বাণিজ্য করিডর গঠনের প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন মমতা। বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। উনি ইতিবাচক আশ্বাস দিয়েছেন। এর পর দেখা যাক কেন্দ্র কী ভাবে রাজ্যের পাশে থাকে।’’
অনেকের মতে, বন্যাত্রাণ ও ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসন নিয়ে কেন্দ্রের কাছে সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি নীতি আয়োগ নিয়ে মমতার সক্রিয় হওয়ার বিষয়টিরও আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। দেশের মুখ্যমন্ত্রীরা নীতি আয়োগের পরিচালন পরিষদের সদস্য। তার সর্বপ্রথম বৈঠকে একমাত্র মমতাই গরহাজির ছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, লোকসভা ভোটের সময় থেকে মোদীর সঙ্গে মমতার যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তারই ফল এই অনুপস্থিতি। এমনকী পরিচালন পরিষদের সর্বশেষ বৈঠকে যখন জমি বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখনও মমতা যোগ দেননি। রাজ্যের বক্তব্য ছিল, বৈঠকের কথা যথেষ্ট আগে জানানো হয়নি। ফলে মুখ্যমন্ত্রী অন্য কর্মসূচি থাকায় আসতে পারেননি। আজ মমতা মোদীকে জানিয়েছেন, এর পর যখন কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্যে চলা রাজ্যের প্রকল্প নিয়ে বৈঠক হবে, তখন যেন অবশ্যই যথেষ্ট আগে জানানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে বৈঠক ডাকবেন তিনি।’’
কেন এই নমনীয়তা? অনেকের মতে, মমতা-মোদী দু’জনেই এখন একটা কাজের সম্পর্ক গড়তে চাইছেন। এর পিছনে রাজনীতি যে পুরোপুরি নেই, এমন নয়। পাঁচ মাস পর রাজধানীতে পা দিয়ে গত কাল সমস্ত বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। আজও শরদ পওয়ার, মুলায়ম সিংহদের সঙ্গে বৈঠক করে আঞ্চলিক দলগুলির একজোট হওয়ার সলতে পাকানোর কাজ সেরেছেন। কিন্তু তারই সঙ্গে ‘সাংবিধানিক সম্পর্ক’কে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের দাবি আদায়েও সমান সক্রিয় থেকেছেন মমতা। যার ফল আজকের বৈঠকে (অন্তত প্রকাশ্যে) ‘সৌহার্দ্যের আবহ’ বজায় থাকা। কারও কারও মতে, মোদী নিজেও মমতার সঙ্গে প্রশাসনিক স্তরে সম্পর্ক ভাল রেখে চলতে চাইছেন। ঠিক যেমন তিনি সুসম্পর্ক রেখে চলছেন এডিএমকে নেত্রী জয়ললিতার সঙ্গে।
তবে মমতার মতো জয়ললিতার সঙ্গে চূড়ান্ত স্নায়ুযুদ্ধে নামতে হয়নি মোদীকে। বেশ কিছু দিন হল, সেই স্নায়ুযুদ্ধের ঝাঁঝ অবশ্য কমেছে। বিরোধীদের দাবি, দু’পক্ষই পরস্পরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। তাই সারদা তদন্তেও সিবিআইয়ের আগের মতো ‘তৎপরতা’ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁরা বলছেন, আগামী দিনে সংসদ চালানোর প্রশ্নে, বিশেষ করে রাজ্যসভায় বিল পাশ করানোর ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতো দলের সমর্থন জরুরি মোদীর কাছে। মনে রাখতে হবে, চলতি বাদল অধিবেশনে মমতার দল কিন্তু ‘ব্যপম’ বা ‘ললিত মোদী কাণ্ড’-এর মতো সরকারের পক্ষে চরম অস্বস্তিকর বিষয় নিয়েও সংসদে আগ্রাসী মনোভাব নেয়নি। মাত্র এক দিন সার্বিক দুর্নীতি এবং জমি বিল নিয়ে প্রতীকী ধর্না করেই যাবতীয় বিরোধিতায় ইতি টেনেছে তারা। তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই এই অভিযোগ উড়িয়ে ফের সাংবিধানিক দায়দায়িত্বের কথা বলেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রের খবর, আজ যে বিষয়গুলি মমতা তুলেছেন, তার মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এখনই পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র। খুব শীঘ্রই মোদী-মমতা বৈঠকের পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হবে রাজ্যের অফিসারদের। বন্যায় রাজ্যের ক্ষতির যে হিসেব কেন্দ্রকে আজ দেওয়া হয়েছে, তার মোট পরিমাণ ২১ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। সঙ্গের চিঠিতে মমতা মোদীকে লিখেছেন, ‘‘উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিপুল আর্থিক বোঝা আমার সরকারের কাঁধে চেপেছে, সে ব্যাপারে আপনি অবগত। এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার মোকাবিলা করা রাজ্যের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ত্রাণ তহবিলের মাধ্যমে সম্ভব নয়। আমার অনুরোধ, জাতীয় বিপর্যয় ত্রাণ তহবিলের টাকা এখনই মঞ্জুর করা হোক, যাতে ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের কাজ দ্রুত শুরু করা যায়।’’
প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়েও আর্থিক প্যাকেজের দাবি জানিয়েছিল রাজ্য। তখন প্রণববাবু রাজ্যের পিছিয়ে থাকা জেলাগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য অনগ্রসর এলাকা অনুদান তহবিল (বিআরজিএফ) থেকে ৮৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ পশ্চিমবঙ্গের জন্য ঘোষণা করেছিলেন। মমতা আজ মোদীকে জানিয়েছেন, এই প্যাকেজের শেষ কিস্তি বাবদ ৩১০০ কোটি টাকা এখনও রাজ্য পায়নি। স্বাস্থ্য, জল সরবরাহ, গ্রামের রাস্তা নির্মাণ, বিদ্যুদয়নের মতো বহু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে, অথবা শেষ হওয়ার মুখে। কিন্তু বকেয়া টাকা পেতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন প্রশ্নের মুখে। বিষয়টি এখন নীতি আয়োগে ঝুলে রয়েছে। এর দ্রুত সুরাহা চেয়েছেন মমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy