রাজ্যের আমলাদের দিল্লি পাঠাতে তাঁর ঘোর আপত্তি। গত চার বছরে দু’এক জন ছাড়া কোনও আইএএস অফিসারকেই কেন্দ্রীয় সরকারি পদে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেননি তিনি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে রাজ্যের মাত্র দু’জন আমলা মনোনীত হওয়ায় সেই তিনিই প্রতিবাদে সরব হলেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে এই ‘অবিচার’-এর প্রতিকার চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে কাজ করার জন্য গত ২৩ জুন ১৯৮২ এবং ১৯৮৫ ব্যাচের আইএএস অফিসারদের তালিকা প্রকাশ করে কেন্দ্রের কর্মিবর্গ ও প্রশিক্ষণ বিভাগ। সারা দেশ থেকে সচিব হিসাবে ৩৬ জন এবং অতিরিক্ত সচিব হিসাবে ৫৪ জন অফিসার মনোনীত হন। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের আমলা মাত্র দু’জন। বাদ পড়েছে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের নামও। অথচ, গুজরাত, পঞ্জাব, অসম উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য থেকে সুযোগ পেয়েছেন অনেক বেশি আমলা। এই ঘটনারই প্রতিবাদ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার অফিসারদের অমর্যাদা হলে কে লড়বে? আমাকেই লড়তে হবে। তাতে ব্যতিক্রমী হলেও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে হয়েছে।’’
কিন্তু তিনিই তো প্রশাসন চালাতে অসুবিধা হবে এই যুক্তিতে তাঁর অফিসারদের ছাড়তে চাননি! মমতার জবাব, ‘‘এ রাজ্যের অফিসাররা দিল্লি যান বা না-যান, কেন্দ্রীয় সরকারে তালিকাভুক্ত হতে পারবেন না কেন? আর যাঁরা যোগ্য, তাঁরা প্রয়োজনে কেন্দ্রে গিয়েও রাজ্যের স্বার্থ দেখবেন।’’
রাজ্যের আমলাদের পাশে দাঁড়িয়ে গত ২৫ জুন বেশ কড়া ভাষাতেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন মমতা। অভিযোগ করেছেন রাজ্যের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং বঞ্চনার। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এখনই বাংলার অফিসারদের তালিকাভুক্ত করার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর এই ভূমিকা আইএএস অফিসারদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ, যে পরিপ্রেক্ষিতে মমতা কড়া ভাষায় মোদীকে চিঠি লিখেছেন, তা আগে কখনও ঘটেনি বলে জানাচ্ছেন প্রশাসনের একাংশ।
কী লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী?
মমতা তাঁর চিঠিতে বলেছেন, ‘বেঙ্গল ক্যাডার দেশের মধ্যে অন্যতম বড় ক্যাডার। প্রতিবার এখান থেকে বেশ কয়েক জন অফিসার (দিল্লিতে কাজ করার জন্য) তালিকাভুক্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু এ বার যে ভাবে বাংলার অফিসারদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তা পক্ষপাতমূলক এবং এ রাজ্যের অফিসারদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার সামিল।’ এখানেই থেমে থাকেননি মুখ্যমন্ত্রী। যে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার (কোঅপারেটিভ ফেডেরালিজম) কথা প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, তারই প্রসঙ্গ তুলে খোঁচা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারে মনোনয়নের ক্ষেত্রে সমস্ত রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব রাখাই নিয়ম। কিন্তু এ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব যে ভাবে খর্ব করা হয়েছে, তা কোঅপারেটিভ ফেডেরালিজমের তত্ত্বের মূলেই আঘাত করছে।’
চিঠিতে মমতার দাবি, ‘যে ভাবে দিল্লির সরকারে কাজ করার জন্য অফিসার বাছাই হয়েছে তা ফের পর্যালোচনা করা হোক।’ নিয়মের বাইরে গিয়ে (আউট অব টার্ন) এ রাজ্যের অফিসারদের দিল্লিতে কাজ করার জন্য মনোনীত করা যায় কি না, তা-ও বিবেচনা করতে বলেছেন তিনি।
দিল্লির তালিকা থেকে কী ভাবে বাদ পড়েছেন এ রাজ্যের অফিসাররা?
সরকারি সূত্রের খবর, ১৯৮২ ব্যাচে বাংলা ক্যাডারের ৬ জন অফিসার ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন ইতিমধ্যেই অবসর নিয়েছেন। বাকি দু’জন কখনও কেন্দ্রীয় সরকারে কাজ না-করায় তাঁদের নাম যে বিবেচিত হবে না, তা জানাই ছিল। বাকি ছিলেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং বর্তমানে দিল্লিতে থাকা হেম পাণ্ডে। কেন্দ্র হেম পাণ্ডেকে সচিব পদে মনোনীত করলেও বাদ পড়েছেন সঞ্জয় মিত্র।
ইউপিএ জমানায় সঞ্জয়বাবু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের দফতরে কাজ করেছেন। তাঁর অ্যানুয়াল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে (এসিআর) ১০-এর মধ্যে ৯ নম্বর দিয়েছিলেন মনমোহন। আর মুখ্যসচিব হিসেবে তিনি মমতার কাছ থেকে ১০-এ ১০-ই পেয়েছেন। অন্য দিকে হেম পাণ্ডে ইউপিএ আমলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশের কাছ থেকে পেয়েছেন সাড়ে ৯।
কিন্তু রাজ্য সরকারগুলির নম্বর দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রের কর্মিবর্গ বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাজ্যে ৮ থেকে ১০-এর মধ্যে যাঁরা নম্বর পেয়েছেন, তাঁদের সকলেরই নম্বর ৯ বলে ধরা হবে। কিন্তু কেন্দ্রের দেওয়া নম্বরের ক্ষেত্রে কোনও কাটছাঁট করা হবে না। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্যগুলির আপত্তি রয়েছে।
তাদের বক্তব্য, রাজ্যগুলি বাড়তি নম্বর দিচ্ছে, এই যুক্তিতে গড় নম্বর দেওয়া অন্যায়। কারণ, সে ক্ষেত্রে তো রাজ্যের দেওয়া ৮ নম্বর কমার বদলে বেড়ে ৯ হয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু কেন্দ্র এখনও এই পদ্ধতিই অনুসরণ করছে। আর তার জেরেই কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে গড়ে সাড়ে নয় নম্বর পাওয়ার বদলে সঞ্জয়বাবুর নম্বর হয়ে যায় ৯। এর পর জটিল অঙ্কের মাধ্যমে সচিবদের তালিকা তৈরি করা হয়। তাতে সামান্য নম্বরের ব্যবধানে বাদ পড়ে যান মুখ্যসচিব।
১৯৮৫ ব্যাচের অফিসারদের মধ্যে থেকে যে ৫৪ জনকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে মনোনীত করেছে কেন্দ্র, তাতে প্রদীপরঞ্জন বাভিস্কার ছাড়া আর কারও নাম নেই। তিনি আবার তিন মাস পর অবসর নেবেন। অথচ ওই ব্যাচে রাজ্যের ৭ জন অফিসার ছিলেন। এঁদের মধ্যে মলয় দে, দেবাশিস সেন কখনও রাজ্যের বাইরে কাজ করেননি। ফলে তাঁদের নাম বিবেচিত হবে না বলে আগেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকা প্রকাশের পরে রাজ্যের আইএএস মহলের প্রশ্ন, তা হলে কখনও রাজ্যের বাইরে গিয়ে কাজ না-করা গুজরাতের গিরিশ মুর্মু এবং রাজস্থানের মধুকর গুপ্ত ও কিরণ সোনি গুপ্ত মনোনীত হলেন কী ভাবে! পাশাপাশি, সুমন্ত চৌধুরী, সঞ্জীব চোপড়া এবং পবন অগ্রবালের মতো অফিসার কেন বাদ পড়লেন, তা নিয়েও সংশয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক মহল।
এর পরেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এটা কয়েকজন অফিসারের পদোন্নতির বিষয় নয়। রাজ্যের মর্যাদার বিষয়।’’ প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, সাধারণ নিয়মে এ সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অফিসাররাই কেন্দ্রের কাছে দরবার করে থাকেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে পুরো প্রক্রিয়াটির উপরই প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছেন তা এক কথায় অভূতপূর্ব।
কিন্তু মমতার চেষ্টায় কোনও কাজ হয়েছে কি? সরকারি সূত্রের খবর, মুখ্যসচিবের নাম যাতে কেন্দ্রীয় সচিব হিসাবে বিবেচিত হয় সে জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আলাদা ভাবে অনুরোধ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মোদীর হস্তক্ষেপে সঞ্জয় মিত্রের নাম কেন্দ্রীয় সচিব হিসাবে শীঘ্রই তালিকাভুক্ত হবে বলে নবান্নে খবর এসে পৌঁছেছে।
তা হলে মুখ্যসচিব কি এ বার দিল্লি চললেন? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘এখনই নয়, পরের কথা পরে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy