Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩
বাঁশ দিয়ে যায় চেনা...

চাপের মুখে ফের কুকথার তোড় মমতার

ছিল বাঁশ, হয়ে গেল বাম্বু। দশ দিনের মধ্যেই অশালীন শব্দপ্রয়োগে নিজের রেকর্ড ভাঙলেন মুখ্যমন্ত্রী। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গত ২২ নভেম্বর দলের কর্মিসভায় বিজেপি নেতাদের আক্রমণ করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কে তুমি? শালা নাম জানে না কেউ।” বলেছিলেন এবং পর ক্ষণে সামলে নিয়ে আপত্তিকর শব্দ প্রত্যাহারও করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপি যে তাঁকে ‘বাঁশ’ দিচ্ছে, সেই দাবি করেছিলেন নির্দ্বিধায়।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৪
Share: Save:

ছিল বাঁশ, হয়ে গেল বাম্বু। দশ দিনের মধ্যেই অশালীন শব্দপ্রয়োগে নিজের রেকর্ড ভাঙলেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গত ২২ নভেম্বর দলের কর্মিসভায় বিজেপি নেতাদের আক্রমণ করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কে তুমি? শালা নাম জানে না কেউ।” বলেছিলেন এবং পর ক্ষণে সামলে নিয়ে আপত্তিকর শব্দ প্রত্যাহারও করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপি যে তাঁকে ‘বাঁশ’ দিচ্ছে, সেই দাবি করেছিলেন নির্দ্বিধায়।

বুধবার একেবারে খাস সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আরও লাগামছাড়া হলেন তিনি। অবলীলায় বললেন ‘পিছনে বাম্বু’ দেওয়ার মতো কুকথা। এ দিন জলপাইগুড়ি স্পোর্টস ভিলেজের উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সমালোচকদের আক্রমণ করে বলেন, “যারা (কাজ) করছে, সারা ক্ষণ তাদের পিছনে কী করে বাম্বু দেওয়া যায়, তার চিন্তা করে বেড়াচ্ছে।” অপশব্দ বলার সঙ্গে রসিয়ে-রসিয়ে হাতের ইশারাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

এ ভাবে বারবার ভাষার সংযম কেন হারাচ্ছেন মমতা? মনোবিদ-ভাষাবিদ থেকে শুরু করে বিরোধী শিবির, সকলেরই মূল বক্তব্য এক। এক দিকে সারদা, অন্য দিকে খাগড়াগড় এবং সর্বোপরি রাজ্যে বিজেপির উত্থান অপরিসীম চাপের মুখে এমনিতেই বেলাগাম দশা। তার মধ্যে গত কয়েক দিনে সাংসদ সৃঞ্জয় বসু গ্রেফতার হয়েছেন, মন্ত্রী মদন মিত্র সিবিআইয়ের তলব পেয়েছেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ। একই দাবি রাজপথে শোনা গিয়েছে বামেদের মুখে। পাশাপাশি, সারদার টাকা তৃণমূলের সূত্রেই জঙ্গিদের হাতে গিয়েছে বলে অভিযোগ করে গিয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। সব মিলিয়ে ‘বংশ’-তালিকা যত লম্বা হচ্ছে, ততই বেসামাল হচ্ছেন নেত্রী।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন প্রথমে সংবাদমাধ্যমকে উদ্দেশ করে বলেন, “যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা... যারা কাজ করছে তাদের পিছনে লেগে গিয়েছে... মন্থরা, কৈকেয়ী টাইপের...!” তার পর বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, “লড়তে পারলে লড়। করতে পারলে কর... কোথায় বলবে বাংলাকে দাও, দিল্লিতে গিয়ে বলছে সব টাকা কেটে নাও। কেউ কেউ আবার বলছে বাংলা ছেড়ে ভাগ। সাহস কত বড়... কথায় বলে বড় বাড় বেড়েছে ঝড়ে পড়ে যাবে।”

এ কথার পরেই আসে বাম্বু-প্রসঙ্গ। ফের সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী বলে ওঠেন, “নিজেরা করতে পারেনি। যারা করছে সারা ক্ষণ তাদের পিছনে কী করে বাম্বু দেওয়া যায়, তার চিন্তা করে বেড়াচ্ছে। বাম্বু জঙ্গলে হয়। ঘরবাড়ি তৈরিতে কাজে লাগে। আর জানে না, বাম্বু দিতে দিতে বাম্বু যখন তাড়া করে না সবাইকে, তখন যে কোথায় যাবে, যাওয়ার আর জায়গা থাকবে না...!”

কে কোথায় যাচ্ছেন, তা নিয়ে অবশ্য ধন্দ নেই বিরোধী নেতাদের। টেলিভিশনে বক্তৃতারত মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, “সে বার ‘বাঁশ’ বলে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর হয়নি দেখে কি এ বার ইংরেজি বললেন?”

এ রাজ্যে রাজনৈতিক নেতাদের মুখে ইতর ভাষা যদিও নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক অতীতে সিপিএমেরই বিনয় কোঙার, অনিল বসু বা আনিসুর রহমানদের অশালীন শব্দপ্রয়োগ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। তেমনই তাঁরাও যে কম যান না, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাপস পাল। বিজেপির মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুকথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে এ দিনই তাপস পালের জন্য সংসদে অপদস্থ হতে হয়েছে তৃণমূলকে। এ দিনই আপত্তিকর ভাষা ও ভঙ্গি করতে দেখা গিয়েছে কল্যাণবাবুকেও। তবে অতীতে নেতারা খারাপ কথা বলে ক্ষমা চেয়ে দোষ লাঘব করার চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে এ দিন কোনও তাপ-উত্তাপ দেখা যায়নি। বরং অন্য দিনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে ঠান্ডা মেজাজেই যা বলার বলে গিয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের মন্তব্য, “অশালীন ভাষা প্রয়োগ এক বার হলে বলা যায় মুখ ফস্কে বেরিয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় বার হলে বুঝতে হবে, তিনি ওই ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত!” আর প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের উক্তি, “একে মুখ্যমন্ত্রী, তায় আবার মহিলা তাঁর মুখে এমন ভাষা অকল্পনীয়!”

ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যান অনুষ্ঠানে উপস্থিত সরকারি আধিকারিক, পুলিশকর্মীদের একাংশ। নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। অনেকে আবার মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ লুকিয়ে হেসে ফেলেন।

তৃণমূল নেতাদের মুখে অবশ্য স্বাভাবিক কারণেই কুলুপ। প্রতিক্রিয়া জানতে এক বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতাকে ফোন করা হলে তাঁর মন্তব্য, “ডেকো না আমারে ডেকো না!” তবে কাজের সূত্রে মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন ভাষা-ভঙ্গিতে তাঁরা যে অভ্যস্ত, সে কথা একান্তে জানাচ্ছেন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরা। দিদির মুখে এমন ‘বংশ-দণ্ড’ তাঁদের গা-সওয়া জানিয়ে জনৈক মন্ত্রীর সহাস্য মন্তব্য, “আমি তো এমনি এমনি খাই।”

ব্যাপারটা হাসির কথা বলে কিন্তু ওড়াতে পারছেন না ভাষাবিদ পবিত্র সরকার। তাঁর কথায়, “অপভাষা বলারও ধরন আছে। বলার ধরন একে বেশি আপত্তিকর করে তোলে।” তাঁর মতে, “বাম্বু অবশ্যই বদ্কথা বা স্ল্যাং। এ সব শব্দ বা বাক্য অবশ্যই সুস্থ সামাজিক পরিসরে ব্যবহারের ভাষা নয়। সভামঞ্চের ভাষা তো নয়-ই।” সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বলছেন, “অনেকে ভাবেন, খারাপ শব্দ ব্যবহার করলে প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু যাঁর সত্যিকারের প্রতাপ রয়েছে তাঁর কখনও এ সব কথা বলার দরকার পড়ে না। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো কোনও সঙ্কটের কারণে জিভের লাগাম হারিয়ে ফেলছেন।”

সঙ্কট-মুহূর্তে অশালীন শব্দ বেরিয়ে পড়ে কেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মনোবিদ জানাচ্ছেন, স্থিতিশীল অবস্থায় মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক সংযম কাজ করে। কিন্তু সঙ্কটে পড়লে স্নায়ুর চাপ বাড়ে। মুখের ভাষা, শরীরের ভঙ্গি কোনও কিছুই তখন আর আগল মানে না। ওই মনোবিদের কথায়, “বেশ কিছু দিন ধরেই মুখ্যমন্ত্রীর চেহারা, চোখেমুখে চাপের ছাপ খুব স্পষ্ট। এ দিনের ভাষাবিভ্রাট তারই উপসর্গমাত্র।”

ঘটনাচক্রে খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ দিন বলেছেন, “ভাল জিনিস নিয়ে কেউ সমালোচনা করলে বা কেউ যদি বলে ‘আপনার এটা ভুল হয়েছে’ আমি তা ওয়েলকাম করি।... আমাদের দেবদেবীরা বলতেন, ভাল কথা বল, ভাল ভাব, ভাল কাজ কর। দেখবে, মনটা-শরীরটা ভাল হয়ে যাবে।”

একের পর এক খারাপ কথা বলে মমতা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, মনটা তাঁর ভাল নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.