মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন। তাই ভাঁড়ার না গুছিয়েই তড়িঘড়ি রোগী ও তাঁদের পরিবারের হাজারো সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেছিল স্বাস্থ্য ভবন। আর তা করতে গিয়েই এখন না গিলতে, না ফেলতে পারার দশা।
জুন মাসের শেষ সপ্তাহে নবান্নে স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে রোগীদের অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তির উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন তিনি। এর পরেই অতি-সক্রিয় হয়ে ২৪ জুন একসঙ্গে দু’টি নির্দেশ জারি করে স্বাস্থ্য ভবন। প্রথমটিতে বলা হয়, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে অভিযোগ সেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। সেলে অভিযোগ জমা পড়া মাত্রই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান করতে হবে। অন্যথায় ভারপ্রাপ্ত কর্তারা শাস্তি পাবেন। দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী, নিয়মিত সরকারি হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরের রোগীদের থেকে জানতে হবে পরিষেবা নিয়ে তাঁরা কতটা সন্তুষ্ট। প্রতিদিন আউটডোর-ইনডোর মিলিয়ে কমপক্ষে ২০ জন রোগীর থেকে তথ্য নিতে আলাদা ছাপানো ফর্ম থাকবে। সমীক্ষা চালাতে হবে হাসপাতালের নিজস্ব কর্মীদের দিয়েই।
নির্দেশ তো বেরোলো, কিন্তু গোল বেধেছে কার্যকর করতে গিয়েই। সমস্যা সেই লোকবলের। হাসপাতালগুলির প্রশ্ন— দৈনিক পরিষেবা চালাতেই ঠেলাঠেলি অবস্থা, তার উপরে এই নতুন বোঝা টানবে কে? কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কথায়, ‘‘ঢাল-তরোয়াল ছাড়া তো আর যুদ্ধ জেতা যায় না।’’ ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশ জারির প্রায় দু’সপ্তাহ পরেও ২৪ ঘণ্টার অভিযোগ সেলই চালু করতে পারেনি বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতাল। নিয়োগ হয়নি আলাদা কর্মীও।
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেমন অভিযোগ ফেলার বাক্স বসিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তাতে রোজ অভিযোগ জমাও পড়ছে— কারও দাবি, প্রসূতিদের পাশে বেড়াল ঘুরছে। কেউ লিখেছেন, বাইপাস অস্ত্রোপচারের ডেট বারবার নির্দিষ্ট হচ্ছে আর বাতিল হচ্ছে। কারও অভিযোগ, মেডিসিনের অমুক ডাক্তারবাবু রোগী দেখতেই আসছেন না। কেউ বা বাক্সে ফেলা চিরকুটে লিখেছেন, ওয়ার্ডে নোংরা বা সকাল আটটা থেকে আউটডোরে লাইন দেওয়ার পরে সাড়ে দশটাতেও ডাক্তারবাবু আসেননি।
‘‘তিন দিন বাক্স খুলতে না পারায় চতুর্থ দিন দেখি তা উপচে পড়ছে। এত চিরকুট পড়ব কী করে! কে, কী করেই বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার সমাধান করবে? কে বেড়াল ধরবে? সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ড সব সময়ে কে ঝকঝকে রাখবে? অত মাইনে পাই না। তাই বাক্স বন্ধ করে চলে এসেছি’’, বলছিলেন কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক।’’
কিন্তু কার্যকর করা সম্ভব নয়, এমন নির্দেশ স্বাস্থ্যভবন দিল কেন? রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর, ‘‘যে সংখ্যাক লোক আছেন, তাঁদেরই এটা করতে হবে। একটু বেশি পরিশ্রম করবেন। হাসপাতালে এক শ্রেণির চিকিৎসক, নার্স ফাঁকি মারেন। তা আর চলবে না। শনিবার চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তাদের চাপ কম থাকে। সে দিন তাঁরা অভিযোগগুলির নিষ্পত্তি করবেন।’’
২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগের সমাধান কি বাস্তবসম্মত? লোকবল না হলে এই নির্দেশ কার্যকর হবে কী করে? সুশান্তবাবু বলেন, ‘’২৪ ঘণ্টার মধ্যে না হোক যদি চারদিনের মধ্যেও সমাধান হয়, সেটাও অনেক। হয়তো রোজ অভিযোগ খতিয়ে দেখা গেল না, সে ক্ষেত্রে সপ্তাহে দু’দিন পারলেও তো কিছুটা এগোনো গেল। প্রতিদিন ১০ এর বদলে যদি ৫ জন রোগীর থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতা জানা যায়, তাতেও অনেক উপকার হবে।’’
এনআরএসের এক কর্তা হতাশ গলায় বলেন, ‘‘অভিযোগ সেলের নোডাল অফিসার করা হয়েছে ডেপুটি সুপারদের। তাঁরা ওষুধের স্টক সামলাবেন, হাসপাতালের প্রাত্যহিক ঝামেলা মেটাবেন নাকি অভিযোগের চিরকুট খুলে পড়ে-পড়ে তার সমাধান হাতড়াবেন?’’ ন্যাশনাল মেডিক্যালের এক কর্তার কথায়, ‘‘এতে লাভ কী হবে জানি না। প্রায় কোনও সিনিয়ার ডাক্তারই সাড়ে ১০টা-১১টার আগে আউটডোরে ঢুকছেন না। এ বিষয়ে অভিযোগ জমা পড়লে আমরা কী করব? বিভাগীয় প্রধানদের এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়ার অধিকারও আমাদের নেই।’’ এসএসকেএমের এক চিকিৎসক কর্তার সহজ সমাধান, ‘‘চিরকুট দেখতে বসা বৃথা, অবাস্তবও। আমরা সিনিয়র ডাক্তারদের রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করে কথা বলতে বলছি। ডাক্তার-রোগীর পরিজনদের মধ্যে খোলাখুলি কথা হলেই সব অভিযোগ আপনা থেকে মিটে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy