নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
রাত প্রায় দু’টো। তখনও তিনি নবান্নে।
এবং বৃহস্পতিবারের রাতটা কাটাবেন সেখানেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর ছেড়ে তিনি কোথাও যাচ্ছেন না।
যতক্ষণ না রাজ্যের বিভিন্ন টোল প্লাজা থেকে সরছে সেনাবাহিনী!
এ দিন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ডানকুনি, পালসিট এবং মুর্শিদাবাদে টোল প্লাজায় গাড়ি থামিয়ে সেনা তল্লাশি চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভয় পাচ্ছেন, নাকাল হচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘এখানে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে নাকি? তবে কি অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থার পাশাপাশি গোটা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হল? আমাদের নির্বাচিত সরকার। আমি সেনার হাতে ছেড়ে দেব না।’’
সেনাবাহিনীর বক্তব্য, এটা তাদের রুটিন কর্মসূচি। কখনও যুদ্ধের পরিস্থিতি হলে রসদ ও পানীয় জল বিভিন্ন ছাউনিতে পৌঁছনোর জন্য প্রচুর মালবাহী গাড়ির প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জওয়ানরা কত গাড়ি নিতে সক্ষম, দু’দিন ধরে পূর্ব ভারতের সব রাজ্যে সমীক্ষার মাধ্যমে তারই হিসেবনিকেশ চলছে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অসম, অরুণাচলপ্রদেশ, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম— সর্বত্রই একাধিক জায়গায় সেনার এই কর্মসূচি চলছে। প্রতিটি দলে ৫ থেকে ১০ জন নিরস্ত্র জওয়ান রয়েছেন। সেনার দাবি, কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে জানিয়েই তারা এই সমীক্ষা চালাচ্ছে। প্রথমে তারা ২৮ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে এই সমীক্ষা চালানোর অনুমতি নিয়েছিল। পরে পুলিশের অনুরোধেই সেই তারিখ পিছিয়ে ১ ডিসেম্বর করা হয় বলে সেনা জানিয়েছে।
যদিও এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, সেনাবাহিনী এ বিষয়ে রাজ্য সরকারকে কিছুই জানায়নি। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি, পুলিশ কমিশনার— সেনার দাবি খারিজ করেছেন প্রত্যেকেই। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, কেরল, ঝাড়খণ্ড— বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। কোথাও সেনা নামানো হয়নি। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে। কেন? মানুষের কথা বলছি বলে? আজকেও অনেকে এটিএমে টাকা পায়নি।’’ তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থেই সেনাকে ব্যবহার করছে কেন্দ্র। এমনকী নবান্নের সামনের (বিদ্যাসাগর সেতুর) টোল প্লাজাতেও সেনা নামানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘পুলিশ কমিশনার সেনাকে বলেছিলেন এখান থেকে সরে যেতে। কারণ এটা স্পর্শকাতর এলাকার মধ্যে পড়ে। কিন্তু তার পরেও তারা সরেনি।’’ যদিও বৃহস্পতিবার মাঝরাত নাগাদ নবান্নের অদূরের টোল প্লাজা থেকে সরে যায় সেনার দলটি। সেনার বক্তব্য, ওই টোল প্লাজা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে বলেই তারা সেখান থেকে সরে গিয়েছে। আজ, শুক্রবার ওই জওয়ানদের অন্য কোথাও মোতায়েন করা হবে।
কিন্তু এর পরেও দফতর ছাড়েননি মমতা। রাতে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর নির্দেশে মমতাকে ফোন করে গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন আহমেদ পটেল। সূত্রের খবর, মমতা তাঁকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি জেলা সেনার ‘দখলে’ চলে গিয়েছে। এটি সেনা অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি। আগামিকাল জাতীয় রাজনীতিতে এ নিয়ে প্রতিবাদে তৃণমূলের পাশে থাকতে চলেছে কংগ্রেস। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সব রাজ্যকে রুখে দাঁড়ানোর আর্জিও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে পাশে বসিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব। কিন্তু এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক। বলছে, তথ্য সংগ্রহ করছে! জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে সমস্ত তথ্য থাকে।’’ নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যসচিব রাতেই কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট সচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে বার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, এই ঘটনা অভূতপূর্ব।
কী ভাবে সমীক্ষা চালাচ্ছে সেনা?
সূত্রের খবর, গাড়ির নম্বর টুকে নিয়ে উইন্ডস্ক্রিনে একটি স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই স্টিকারে লেখা আছে, ‘ই-১’। এর অর্থ, সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ড ওই গাড়িটিকে তাদের গণনায় ধরেছে। তাই ওই গাড়ি অন্যত্র গেলে অন্য কম্যান্ড বুঝে যাবে, তার নম্বর আগেই ইস্টার্ন কম্যান্ডের খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে। ফলে তারা আর সেই গাড়িকে হিসেবে ধরবে না। সেনার দাবি, তাদের কাজের সুবিধের জন্যই এই স্টিকার। নির্দিষ্ট সময় পরে গাড়ির মালিক স্টিকার খুলে নিতে পারেন। এ রাজ্যে পালসিট, ডানকুনি ও বিদ্যাসাগর সেতুর টোল প্লাজায় ওই কাজ চলেছে বলে সেনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। টোল প্লাজাকেই কেন বাছা হল? সেনার যুক্তি, টোল প্লাজার লেনগুলিতে সারি দিয়ে গাড়ি ঢোকে। গতিও কমে যায়। গাড়ির নম্বর লিখতে ও স্টিকার লাগাতে সুবিধে হয়। রাস্তা চওড়া থাকে বলে যানজটও হয় না। ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্র এস এস বিরদি বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘প্রত্যেক বছর এই কর্মসূচি চলে। এতে কোনও একটি এলাকা দিয়ে দিয়ে কত গাড়ি যাচ্ছে, তার একটা হিসেব নেওয়া হয়। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ইস্টার্ন কম্যান্ডের এলাকায় এই কর্মসূচি তিন দিন চলবে। আগামিকালই (শুক্রবার) শেষ দিন।’’
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য অনড়। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি জনগণের পাহারাদার। রাজ্যের সব জায়গা থেকে যতক্ষণ না সেনাবাহিনী সরছে, তত ক্ষণ আমি নবান্ন ছেড়ে যাব না।’’
আরও পড়ুন:
রাজ্যকে আগাম জানিয়েই সব হয়েছে, মমতার অভিযোগ ওড়াল সেনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy